বাংলাদেশ স্কাউটস নোয়াখালী জেলা রোভারের সম্পাদক জনাব মোঃ আব্দুল জলিল।
জন্ম : ১৮ জানুয়ারী, ১৯৬৯
মৃত্যু : ২ এপ্রিল, ২০২২
কর্মজীবনে তিনি সৈকত সরকারি কলেজের শারীরিক শিক্ষা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
আমার রোভারিং শুরুর দিকেই স্যারের সাথে আমার পরিচয় হয়। আমি ২০১৫ সালে ডিসেম্বর মাস থেকে নোয়াখালী সরকারি কলেজ রোভার স্কাউট গ্রুপ থেকে রোভার স্কাউট শাখায় স্কাউট আন্দোলনে যুক্ত হই।
কয়েক মাস ক্রু মিটিং করার পর ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে কলেজ রোভারে ডে ক্যাম্প এ স্যার উপস্থিত ছিলেন। চোখে চশমা পড়া। সেই ডে ক্যাম্পে স্যারকে দেখেছিলাম খুব কাছ থেকেই। সেই সময় অনেক জুনিয়র থাকায় স্যারের সাথে সরাসরি কাজ করার সুযোগ হয় নি। তবে জেলা রোভারের বিভিন্ন কার্যক্রমে স্যারের সাথে দেখা হতো কথা হতো।
একটি পর্যায়ে বিভিন্ন কাজে স্যারের মাইজদী বাজার বাসায় যাওয়া হতো। এর মাঝে আমার রোভার প্রোগ্রামে প্রশিক্ষণ স্তরের শেষ পর্যায়ে স্যারের কাছে লগ বই এর প্রয়োজনে অনেকবার যাওয়া হতো।
একপর্যায়ে আমি সেবা স্তরের শুরুর দিকে আমার পরিভ্রমণকারী ব্যাজ অর্জনের জন্য স্যারের কাছে বিভিন্ন পরামর্শ নি। স্যার জেলা রোভার থেকে আগে যারা পরিভ্রমণকারী ব্যাজ অর্জন করেছে তাদের লগ বুকের একটি কপি আমাকে দিয়ে বলেন এই অনুযায়ী অনুমতি নিতে হবে তার জন্য কাগজ পত্র ঠিক করো।
স্যারের নির্দেশনা মতাবেক তৎকালীন আমার এস আর এম জনাব মিজানুর রহমান ভাইয়ের সহযোগীতায় আমি পরিভ্রমণের অনুমতির জন্য সব ঠিক করি। কলেজ রোভার ও জেলা রোভারের অনুমতি নিয়ে যাত্রা শুরু করি।
স্যার এতটাই দায়িত্ববান সম্পাদক ছিলেন প্রতিনিয়ত আমরা পরিভ্রমণকারী টিম এর খোজখবর নিতেন।পথে যেকোনো প্রয়োজনে স্যারের সাথে যোগাযোগ করলেই স্যার সমস্যা সমাধান করে দিতেন। পরিভ্রমণকারী ব্যাজ অর্জনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত স্যারের সহযোগীতা ভুলার মতো না।
স্যারের সাথে একাদশ জাতীয় রোভার মুট, কমডেকা, অষ্টাদশ আঞ্চলিক রোভার মুট সহ জেলা পর্যায়, অঞ্চল পর্যায় ও জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন ক্যাম্প ও প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাই।
অনলাইন ডাটাব্যাজ ও সার্ভিস পোর্টালে স্যারের সাথে ফেনী কলেজ এ একসাথে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করি। সেইদিন স্যারের জন্মদিন ছিলো কিন্তু আমি ফেজবুকে না থাকাতে জানা ছিলো না। সেদিন স্যারের সাথে ফেনী জেলায় ঘুরলাম। বাসায় এসে দেখি আজ স্যারের জন্মদিন পরে ফোন করে স্যারকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ছিলাম।
তখন থেকে স্যারের মৃত্যু পর্যন্ত আমি মনে হয় স্যারের খুব বিশ্বস্ত ছিলাম। জেলা রোভারের বিভিন্ন প্রোগ্রামে স্যার আমাকে বিভিন্ন দায়িত্ব দিতেন। আমি চেষ্টা করতাম স্যারের দেওয়া দায়িত্ব নিজের সর্বোচ্চ টা দিয়ে পালন করার।
২০২০সালের শেষ দিকে আমি সহ নোয়াখালী কলেজ রোভারের ৩জন পিআরএস মূল্যায়নে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তখন লগ বই, মাই প্রোগ্রেস বই এ স্বাক্ষর সহ বিভিন্ন কাজে স্যারের থেকে সবচেয়ে বেশি সহযোগীতা পেতাম। পিআরএস প্রস্তুতির জন্য যখন যে সহযোগিতা চেয়েছি স্যার সব সময় বাবার মতো পাশে ছিলেন।
পিআরএস অঞ্চল ও জাতীয় পর্যায়ে মূল্যায়নে অংশগ্রহণ করে জেলা রোভারের স্বপ্ন এবং আমার স্বপ্ন পিআরএস অর্জনের জন্য যতটুকু পরিশ্রম করার করেছিলাম।
১১জানুয়ারী ২০২১সাল বিকাল ৫টায় যখন দেখলাম পিআরএস এর চূড়ান্ত ফলাফলে ১৪জনের মধ্যে আমি একজন নোয়াখালী জেলা রোভার থেকে ১ম বারের মতো পিআরএস অর্জন করি তখন আমার আর এস এল স্যারকে জানানোর পরেই জলিল স্যারকে ফোন করে জানাই।
স্যার আমার অর্জনের কথা শুনে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলেন। সন্ধ্যায় আমি স্যারের বাসায় গিয়ে স্যারকে সালাম দিই। স্যার আমাকে বুকে টেনে নেন ও নিজ হাতে মিষ্টি মুখ করান। তখন স্যার আমাকে বলেন আমার মাধ্যমে উনি সম্পাদক হিসেবে সফল হয়েছেন। তখন নিজেকে আরো বেশি গৌরবান্বিত মনে হলো স্যারের থেকে এই কথা শুনে।
পরের মাসেই খবর এলো আমি চট্টগ্রাম বিভাগের শ্রেষ্ঠ রোভার মনোনীত হয়েছি।স্যারকে জানানোর পরে স্যার এটাতেও খুব খুশি হয়েছেন। শ্রেষ্ঠ রোভারের সম্মাননা আনার সময় খুব ইচ্ছে ছিলো স্যারের সাথে যাবো কারণ তখন রোভার অঞ্চলের বার্ষিক সভা ছিলো। কিন্তু এর কিছুদিন আগে স্যার বিদ্যুতের শর্ট সার্কিটে আহত হয়েছিলেন। স্যারের পায়ে আঘাত পান। তাই স্যার যান নি। পরে জেলাতে এসে স্যারকে সম্মাননা দেখাই।
২১মার্চ নিজের ব্যক্তিগত কাজে হঠাৎ সৈকত সরকারি কলেজ যাই। সিনিয়র রোভার মেট ইব্রাহিম খলিল শিমুল কে কলেজ মাঠে গিয়ে ফোন দিয়ে শুনি ডেন খোলা এবং রোভাররাও আছে। তাই ডেনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
কলেজ ডেনের ২য় তলায় উঠে দেখা হলো প্রিয় স্যারের সাথে। আমাকে হঠাৎ দেখে স্যারের সেই মায়াবি হাসি। এরপর স্যার সহ নিয়ে গেলেন ডেনে। এটাই যে স্যারের সাথে আমার শেষ দেখা হবে তা সত্যি এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।
স্যারের পাশে বসে তখন সৈকত কলেজ রোভারদের উদ্দ্যেশে একটা কথাই বলেছিলাম ” আপনারা অনেক ভাগ্যবান জলিল স্যারের মতো একজন দক্ষ রোভার লিডার পেয়েছেন। ” কে জানতো খুব শীঘ্রই সৈকত কলেজ রোভার এবং পুরো নোয়াখালী জেলা রোভার এমন একজন মানুষকে হারাবে।
গত ৩১ মার্চ লক্ষীপুর জেলা রোভারের কোর্স ফর রোভার মেটে যাওয়ার আগে স্যারকে ফোন করে জানাই। স্যার তখন উনার মেয়েকে মেডিকেলে পরীক্ষা দেওয়ানোর জন্য কুমিল্লা গিয়েছিলেন। সেই ফোন কলেই স্যারের সাথে শেষ বারের জন্য কথা হয়।
২তারিখে দুপুর ১টায় খবর পেলাম আমাদের নোয়াখালী জেলা রোভারের উজ্জ্বল নক্ষত্র জেলা রোভারের সম্পাদক জনাব মোঃ আব্দুল জলিল স্যার আমাদের মাঝে আর নেই। রাতের ১০টায় স্যারের খাট কাঁধে নিয়ে স্যারকে কবরে নামিয়ে শেষ বিদায় জানালাম।
পরকালে আল্লাহ আপনাকে জান্নাত দান করুন, আমিন। নোয়াখালী জেলার স্কাউট অঙ্গন একজন ভালো মানুষ হারালো।
লেখক
প্রেসিডেন্ট’স রোভার স্কাউট,
চট্টগ্রাম বিভাগীয় শ্রেষ্ঠ রোভার (২০১৯-২০), বাংলাদেশ স্কাউটস নোয়াখালী জেলা রোভার।