কোন পথে এগোচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম?

মো. আরফাতুর রহমান (শাওন)
বুধবার, ৫ এপ্রিল, ২০২৩, ৩:৩০ অপরাহ্ন

শিক্ষার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তুলবার শক্তিশালী ও কার্যকর এবং প্রয়োগযোগ্য সুষ্ঠু সবল শিক্ষা সম্বন্ধীয় পরিকল্পনা হলো শিক্ষাক্রম। শিক্ষাকে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের পাথেয় হিসেবে ব্যবহার করে বিশাল জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে পরিণত করার জন্য অপরিহার্য হাতিয়ার হলো শিক্ষাক্রম।

নতুন শিক্ষাক্রমে তৃতীয় শ্রেণি এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকবে না, এই সিদ্ধান্তে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত কতটুকু যুক্তিযুক্ত। শিশুদের পরীক্ষার মতো প্রতিযোগিতামূলক আসর থেকে সরিয়ে রাখার সৎ ইচ্ছাকে সাধুবাদ জানাই। তবে, সমস্যা হচ্ছে, বিষয়টি চমত্কার ও সময়োপযোগী হলেও কার্যকারিতার দিক থেকে হয়তো আমাদের দেশের অন্য অনেক প্রকল্পের মতোই হতে যাচ্ছে। আরো সহজ কথায় যদি বলতে হয়, ধরা যাক, চমত্কার পলিসি তৈরি করা হলো, যেখানে বাংলাদেশের সব শিশু শিক্ষার্থী চিন্তাশীল হবে। পলিসি তৈরি করলেই কি হয়ে যাবে? পরিকল্পনা আসলে কোনো কাজেই আসবে না, যদি এর জন্য ভালো জোগান বা রিসোর্স না থাকে। এর অর্থ, ভালো পলিসি ততক্ষণ পর্যন্ত সমাজের জন্য সুফল বয়ে আনে না, যতক্ষণ পর্যন্ত ঐ ভালো পলিসি মানার জন্য শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরি না হয়। পরীক্ষা বা জবাবদিহি ছাড়া কোনো সামাজিক পদ্ধতি, বিশেষ করে সরকারি কোনো কাজ প্রতিষ্ঠিত হবে না।

কোনো নির্দেশনা এবং সেই নির্দেশনার পেছনে গবেষণার উপাত্ত না থাকার কারণে বিভিন্ন অঞ্চলের শিশুর বিভিন্ন মানুষের সংস্পর্শে বিভিন্ন ধরনের চিন্তা তৈরি হবে। এতে প্রথমত চিন্তার ব্যবধান আকাশপাতাল হবে এবং দ্বিতীয়ত সমাজে আরো ভালোভাবে প্রমাণিত হবে যে, টাকা বা অর্থই আসল। প্রশ্নের ধরন এখনো ঠিক না হওয়ায় শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা অস্পষ্টতার মধ্যে আছেন। আবার শিক্ষার্থীরাও অনেকটা অন্ধকারে আছে। পরীক্ষার একেবারে আগমুহূর্তে প্রশ্নের ধরন জানালে প্রস্তুতির সময় থাকবে না। এতে শিক্ষার্থীরা অসুবিধায় পড়তে পারে। তাছাড়া শিক্ষার্থীরা বাসায় গিয়ে বই স্পর্শ করা থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের পড়ার কথা বললেই তারা উত্তর দিচ্ছে পরীক্ষা নাই, তাহলে পড়ব কেন। শিক্ষার্থীদের সন্ধ্যায় কিংবা রাতে দেখা যাচ্ছে ঘরের বাইরে। যেখানে তাদের উক্ত সময়ে পড়ার টেবিলে থাকার কথা ছিল।

প্রথাগত পরীক্ষার চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়ন (শিখনকালীন) বেশি হওয়ার কথা ছিল। তবে দেখা যাচ্ছে এর উলটোটা ঘটছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় পাওয়া যাচ্ছে মূল্যায়নের উত্তর, বাজারে বের হচ্ছে গাইড বই, যা নতুন শিক্ষাক্রমের প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াবে। তাছাড়া শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না দেওয়ার কারণে তারা বুঝে উঠতে পারবেন না, মূল্যায়নের বিষয়টি। মূল্যায়ন কীভাবে করবেন? নতুন শিক্ষাক্রমে অস্পষ্টতার কারণে শিক্ষার্থীরা আগের থেকে বেশি প্রাইভেটকেন্দ্রিক হতে দেখা যাচ্ছে, যা নতুন শিক্ষাক্রমের উদ্দেশ্যকে বাধাগ্রস্ত করছে বলে অভিভাবকদের ধারণা।

কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে বলা হচ্ছে, শিক্ষক সরাসরি কোনো বিষয় বা টপিক পড়ানো শুরু করবেন না। চারটি ধাপ অনুসরণ করে শিক্ষক পাঠদানের কাজটি করবেন। প্রথম ধাপে তিনি কোনো একটি বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থীদের মতামত যাচাই করবেন। এক্ষেত্রে তিনি শিক্ষার্থীদের একক কাজ দিতে পারেন, দলগতভাবেও কাজ করার সুযোগ দিতে পারেন। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষক তাদের জ্ঞানের স্তর সম্পর্কে ধারণা পাবেন এবং দুর্বল শিক্ষার্থীকে শনাক্ত করতে পারবেন। দ্বিতীয় ধাপে শিক্ষক প্রত্যেকের বা প্রতিটি দলের মতামতের ভিত্তিতে অন্য শিক্ষার্থীদের অভিমত বা প্রতিক্রিয়া লক্ষ করবেন। আদৌ কি তা বাস্তবে  অনুসরণ করে পাঠদান করানো হচ্ছে কি না, তা দেখা জরুরি।

বলা হয়েছিল, পাঠদান প্রক্রিয়ার মতো মূল্যায়নপদ্ধতিও আগের মতো থাকছে না। মূল্যায়নের কাজটি চলবে মূলত বছর জুড়ে। শ্রেণিকক্ষের বিভিন্ন কাজের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত যোগ্যতাগুলো অর্জন করার চেষ্টা করবে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থী কতটুকু যোগ্যতা অর্জন করেছে, বা কতটুকু পারছে, শিক্ষক সেটুকু অ্যাপসে বা এক্সেল শিটে চিহ্নিত করে রাখবেন। এখনো কি এগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে? নাকি মুখে মুখেই বলা হচ্ছে।

শিক্ষা কোনো পণ্যসামগ্রী নয়। এটা অর্জনের বিষয়। তাই শিক্ষার্থীকেই শ্রেণিকক্ষ ও শ্রেণিকক্ষের বাইরে জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হতে হবে। তাই উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে জাতির সৃজনশীলতার বিকাশ দক্ষ ও মেধাসম্পন্ন সমাজ গঠনে শিক্ষাব্যবস্থার ওপর সমধিক গুরুত্বারোপ করা হয়। নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠদান পদ্ধতি ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়া যথাযথভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান সম্ভব। তাছাড়া মূল্যায়নের সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড অতি দ্রুত শিক্ষকদের কাছে পৌঁছাতে হবে, নতুবা চলতি বছরে শিক্ষার্থীরা শিখন ঘাটতিতে পড়বে, যা তাদের ক্ষতির দিকে নিয়ে যাবে। তবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নানা সংকট ও অসংগতি থাকা সত্ত্বেও এর যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।

শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিশুদ্ধ স্বচ্ছ করতে শিক্ষা খাতের বিভিন্ন সমস্যা অতি দ্রুত দূর করতে হবে। শিক্ষার নানামুখী সংস্কারের পাশাপাশি সরকারকে শিক্ষা পুরোপুরি জাতীয়করণের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করতে একটি দেশকে অনেক দিনের চিন্তাভাবনার মধ্য দিয়ে আগাতে হয়। কারণ শিক্ষা কার্যক্রম, এর কারিকুলাম, শিক্ষার ধরন একটি জাতির মস্তিষ্কের সেটআপ তৈরি করে। এক, দুই বা পাঁচ বছরের চিন্তায় নয়, বরং কমপক্ষে ১০-২০ বছর অবজার্ভ করতে হয়।

লেখক :শিক্ষক, মিল্লাত উচ্চবিদ্যালয়, বংশাল, ঢাকা

Facebook Comments
Print Friendly, PDF & Email
সংবাদটি শেয়ার করুন


আরো সংবাদ
Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com