অ্যান্টিবায়োটিক এমন একটি জৈব-রাসায়নিক উপাদান, যা ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাক থেকে তৈরি হয় এবং ব্যবহূত হয় ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাককে ধ্বংস এবং বংশবৃদ্ধি রোধ করতে। ১৯২৮ সালে আলেকজান্ডার ফ্লেমিং কর্তৃক পেনিসিলিন আবিষ্কারের পর থেকেই মূলত বিশ্ব প্রবেশ করে অ্যান্টিবায়োটিকের যুগে। তার পর থেকেই সংক্রামক রোগে জীবনরক্ষাকারী মহৌষধ হিসেবে ব্যবহূত হয়ে আসছে অ্যান্টিবায়োটিক।
এর আগে সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে ছিল না সে ধরনের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা। ফলে সামান্য কাটাছেঁড়া কিংবা সর্দিজ্বরেই ঘটত প্রাণহানির মতো ঘটনা। সংক্রামক রোগ নির্মূলে কার্যকর ভূমিকা পালন করে চললেও বর্তমানে এর অপপ্রয়োগ এবং যথেচ্ছ ব্যবহারে ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স’ নামক মারাত্মক সংকটের মুখে পড়েছে সমগ্র বিশ্ব। ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা হ্রাস অর্থাত্ জীবাণুদের নির্দিষ্ট ওষুধের বিপরীতে বেঁচে থাকার সামর্থ্যই হলো অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২২টি দেশের পরিচালিত জরিপে ৫ লাখ মানুষের মধ্যে এমন ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পাওয়া গেছে, যা এক বা একাধিক অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি রেজিস্ট্যান্ট।
যথেচ্ছ ব্যবহারে কার্যকারিতা হারাচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অ্যান্টিবায়োটিকের বিপণন ও সেবন হয়ে থাকে মুড়ি-মুড়কির মতো। ঐতিহ্যগতভাবে এ দেশের সাধারণ জনগণের একটি বৃহত্ অংশই রোগের চিকিত্সায়, চিকিত্সকের চেয়ে ওষুধ দোকানির ওপর বেশি আস্থাশীল হওয়ার ফলে অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে। সামান্য ঠান্ডা, জ্বর, সর্দি কিংবা পেটব্যথার মতো অসুখে অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের চিত্র আমাদের সমাজে ভূরি ভূরি। এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে মাত্র ৮ শতাংশ অ্যান্টিবায়োটিক চিকিত্সকের পরামর্শে বিক্রি করা হয়। প্রতিটি ওষুধেরই রোগ নির্মূলে একটি নির্দিষ্ট মাত্রা ও সেবনবিধি রয়েছে। বাংলাদেশের বেশির ভাগ রোগীদের মধ্যেই দেখা যায় বিধি মানার অনীহা। যার ফলাফল খুবই মারাত্মক। অ্যান্টিবায়োটিকের সেবনমাত্রা পূর্ণ না হওয়ার ফলে ঐ রোগীর দেহের জীবাণু তার নিজের জেনেটিক কোডে এমনভাবে পরিবর্তন আনে, যেন পরবর্তী সময় ঐ অ্যান্টিবায়োটিক জীবাণু ধ্বংসে কার্যকর হতে না পারে। ফলে সাইটোটক্সি ব্যাকটেরিয়া পরিণত হয় ইমিউনোটক্সি।
সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয়, দ্রুত বংশবিস্তারকারী এসব ব্যাকটেরিয়া অতি অল্প সময়ের মধ্যেই এমন লাখ লাখ ওষুধ প্রতিরোধী ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি করতে পারে, যার আক্রমণে মানবশরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধে অসমর্থ হয়। ফলে সাধারণ সর্দি-কাশিও হয়ে ওঠে মরণব্যাধি। বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা-প্রতিষ্ঠান ‘আইইডিসিআরের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে অন্তত ১৭টির কার্যক্ষমতা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে, যা আগামী প্রজন্মের জন্য অশনিসংকেত। এছাড়াও অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের ফলে শরীরের প্রয়োজনীয় ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস হয়ে যায়, যা দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক জটিলতা সৃষ্টি করে। বিশ্ব জুড়ে হাঁস-মুরগি বা গরু-ছাগলের খামারিদের অধিক উত্পাদনের আশায় স্বল্পমেয়াদি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ছে ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া। চিংড়ি, মেস্য ব্যবহূত হরমোন এবং শাকসবজিতে ব্যবহূত কীটনাশকের মাধ্যমেও বাড়ছে এসব ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া, যা খাদ্য গ্রহণ এবং পরিবেশের মাধ্যমে প্রবেশ করছে মানবশরীরে, বাড়িয়ে তুলছে অনাগত মহামারির ঝুঁকি।
কাজ করছে না অ্যান্টিবায়োটিক
জীবাণুর অ্যান্টিবায়োটিকসহ যে কোনো ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন বিশ্বব্যাপী একটি জটিল সমস্যা, যা কিছু মানুষের স্বেচ্ছাচারিতায় সৃষ্টি হয়ে সমগ্র বিশ্বের মানুষকে ভোগাচ্ছে। যথেচ্ছ ও নির্বিচার ব্যবহারের ফলে সাধারণ মানের কোনো অ্যান্টিবায়োটিকে সুফল পাওয়া যাচ্ছে না, যা চিকিত্সাব্যয় এবং মৃত্যুঝুঁকি ক্রমেই বাড়িয়ে তুলছে। অন্যদিকে কার্যকরী অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারেও পৃথিবীব্যাপী বিরাজ করছে স্থবিরতা। গবেষকদের মতে, একটি অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কৃত হতে গড়ে সময় লাগে ১৫ বছর, বিপরীতে সেটি রেজিস্ট্যান্ট হতে সময় লাগে মাত্র এক বছর। অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য বয়ে আনছে মারাত্মক ঝুঁকি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওষুধ প্রতিরোধী জীবাণুর ঝুঁকির তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশও। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে অকার্যকর হয়ে পড়বে চিকিৎসাব্যবস্থা। তাই ওষুধ প্রতিরোধী জীবাণু সংকট মোকাবিলায় অ্যান্টিবায়োটিকের অপপ্রয়োগ বন্ধে উদ্যোগী হতে হবে। এক্ষেত্রে গণসচেতনতার পাশাপাশি প্রয়োজন আইনের কঠোর প্রয়োগ। সকলের সম্মিলিত অংশগ্রহণ এবং সচেতনতার মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধ করতে পারলে একদিকে যেমন ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া কমানো সম্ভব হবে, তেমনিভাবে ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্যও গড়ে উঠবে সুস্থ-স্বাভাবিক বাসযোগ্য পৃথিবী।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়