দর্জির ছেলে মহাদুর্নীতিবাজ পিকের উথ্থান-পতন

পিরোজপুর প্রতিনিধি
রবিবার, ১৫ মে, ২০২২, ৮:৫৬ পূর্বাহ্ন

বহুল আলোচিত তিন হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাচারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ লোপাটকারী প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার একজন গরিব দর্জির ছেলে। সাধারণ পরিবারের সন্তান হয়েও প্রশান্ত বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ ও বিত্ত-বৈভবের মালিক বনে গেছেন। দেশে-বিদেশে তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ফ্ল্যাটসহ বিপুল সম্পত্তি রয়েছে।

শনিবার পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে পিকে হালদার গ্রেফতার হয়েছেন। এ গ্রেফতারের পর তিনি আবার আলোচনায় এসেছেন। কলকাতায় প্রশান্তের বিলাসবহুল ১০টি বাড়ি সিলগালা করা হয়েছে। তার অর্থ লোপাটের সহযোগীরাও সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা। সবার বাড়ি পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে।

এলাকাবাসীর সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, আলোচিত পিকে হালদারের বাবা প্রণবেন্দু হালদার পেশায় ছিলেন দীঘিরজান বাজারের একজন দর্জি। আর মা লীলাবতী হালদার ছিলেন স্কুলশিক্ষক। দীঘিরজান মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও পাশের বাগেরহাটের সরকারি পিসি কলেজ থেকে তিনি এইচএসসি পাশ করেন।

এরপর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্ট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি নিয়ে তিনি বেক্সিমকো গ্রুপের জুট ফ্যাক্টরিতে চাকরি করেন। ১৫-১৬ বছর আগে ভিন্ন ধর্মের এক নারীকে বিয়ে করার পর থেকে তিনি গ্রামছাড়া। পিকে হালদারের অর্থ পাচারের কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর লীলাবতী আরেক ছেলে প্রীতিশ হালদারের বাড়ি ভারতের অশোকনগরে চলে যান। পিকে হালদারের আরেক ভাই প্রাণেশ হালদার কানাডায় অবস্থান করছেন জানা গেছে।

দীঘিরজান গ্রামের অধ্যক্ষ দীপ্তেন মজুমদার জানান, প্রশান্তকে (পিকে) মেধাবী ছাত্র বলে এলাকাবাসী চিনত। দীর্ঘদিন ধরে এলাকার সঙ্গে তার তেমন কোনো যোগাযোগ নেই। সবাই জানত প্রকৌশলী হয়ে তিনি অনেক বড় চাকরি করেন। ১৫-১৬ বছর আগে তিনি এক মুসলিম নারীকে বিয়ে করেছেন বলে গ্রামে প্রচার হয়। কুষ্টিয়ায় তার একটি জুট মিলসহ কোটি কোটি টাকার ব্যবসার কথা জানে সাধারণ মানুষ।

১০ বছরের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা নিয়েই ২০০৯ সালে পিকে হালদার অদৃশ্য আশীর্বাদে রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি বনে যান। এরপর ২০১৫ সালের জুলাইয়ে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি পদে যোগ দেন। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে কমপক্ষে চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) মালিকানায় অস্বাভাবিক পরিবর্তন আসে। সেই চার প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা এখন চরম খারাপ। একটি বিলুপ্তের পথে, বাকি তিনটিও গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। নানা কৌশল করে এসব প্রতিষ্ঠান দখল করেন পিকে হালদার। প্রতিষ্ঠান দখল করার জন্য নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলেছেন, শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কিনেছেন, দখল করা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের নামে টাকাও সরিয়েছেন। এমনকি দেশের বাইরেও তিনি কোম্পানি খোলেন।

২০১৪ সালে কানাডায় পিঅ্যান্ডএল হাল হোল্ডিং ইনক নামে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন পিকে হালদার। কানাডা সরকারের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী-টরেন্টোর ডিনক্রেস্ট সড়কের ১৬ নম্বর বাসাটি তার। এছাড়া ২০১৮ সালে দুই ভাই (প্রশান্ত ও প্রীতিশ) মিলে পশ্চিমবঙ্গে হাল ট্রিপ টেকনোলজি নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। কলকাতার মহাজাতি সদনে এর কার্যালয়। ২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে তার দখল করা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকের টাকা ফেরত দিয়ে ব্যর্থ হলে পিকে হালদার ভারতে পালিয়ে যান। এরপর তিনি কানাডা ও সিঙ্গাপুরে বসবাস শুরু করেন। তবে সম্প্রতি তিনি আবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন।

বর্তমানে পিকে হালদারের গ্রামের বাড়িতে পুরোনো একটি কাঠের টিনশেড ঘর আছে। যেখানে তার চাচাতো ভাই দীপেন্দ্র নাথ হালদার বসবাস ও দেখাশোনা করেন। দীপেন্দ্র জানান, এ বাড়ি তিনি দেখাশোনা করছেন। কিন্তু প্রশান্ত বা তার ভাইয়েরা কেউই তাদের খোঁজখবর রাখেন না। প্রশান্তের অর্থ কেলেঙ্কারির খবর শোনার পর থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তিনি ভয় ও শঙ্কার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। পিকে হালদারের অন্যতম সহযোগী বোন মঞ্জু রানীর দুই ছেলে স্বপন মিস্ত্রি ও উত্তম মিস্ত্রি। এ দুজনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ দুজনও শনিবার কলকাতায় গ্রেফতার হয়েছেন।

পিকে হালদারের ব্যবসা-বাণিজ্য দেখাশোনা করেন ম্যানেজার অঙ্গন হালদার। দীঘিরজান গ্রামে মা লীলাবতীর নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন পিকে হালদার। কলেজটির তত্ত্বাবধায়ক অঙ্গন হালদার। পিকে হালদারের দেহরক্ষীর সঙ্গে মেয়ে অনিন্দিতার বিয়ে দিয়েছেন নাজিরপুর উপজেলার বাকসি গ্রামের সুকুমার মৃধা। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি, খুলনার রূপসা কলেজের অধ্যক্ষসহ একাধিক চাকরি করেন এবং এসব প্রতিষ্ঠান থেকে দুর্নীতির দায়ে চাকরি হারান সুকুমার। নিজ গ্রাম বাকসিতে তিনি রাজলক্ষ্মী ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। খাস জমিতে কলেজ, কিন্ডারগার্টেন, বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পাঁচটি মন্দির, দুস্থ ছাত্রীনিবাস, বৃদ্ধাশ্রম ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করেন। শনিবার সুকুমারও গ্রেফতার হয়েছেন।

দুদকের হাতে আটক পিকে হালদারের সহযোগী ও বান্ধবী অবন্তিকা বড়াল ওরফে কেয়ার গ্রামের বাড়ি নাজিরপুর উপজেলার সদর ইউনিয়নের আমতলা গ্রামে। পিরোজপুর শহরের খুমুরিয়া এলাকায়ও তাদের বাড়ি রয়েছে। অবন্তিকার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা অরুণ কুমার বড়াল ছিলেন সরকারি কলেজের প্রভাষক। বাবার মৃত্যুর পর মা ও বোনসহ অবন্তিকা ঢাকায় চলে যান।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে খুমুরিয়া এলাকার এক বাসিন্দা জানান, অবন্তিকার বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবারটি খুবই দুরবস্থার মধ্যে পড়েছিল। অথচ কয়েক বছরের ব্যবধানে পরিবারটি কয়েক কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।

Facebook Comments
Print Friendly, PDF & Email
সংবাদটি শেয়ার করুন


আরো সংবাদ
Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com