মানিব্যাগ
আরিফ মাহমুদ শৈবাল
তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। ২০০০ সাল। মুহসীন হলে থাকি। সকাল-বিকেল টিউশনির ফাঁকে ক্লাস আর পড়াশোনা। কখনো ক্লাস এবং পড়াশোনার ফাঁকে টিউশনি।
কয়দিন পরই সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা। হলের কোলাহল এড়িয়ে সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে পড়তে যাচ্ছি। লাইব্রেরির সামনে বান্ধবী-সহপাঠী ঐন্তির সঙ্গে দেখা। বারান্দায় বসে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে যে যার পথে। লাইব্রেরির তিন তলায় চলে এলাম।
বইয়ের পাতায় মগ্ন হওয়ার চেষ্টা করছি। তিনটার সময় মগবাজারে একটা টিউশনি আছে। হাতে ঘণ্টা তিনেক বা চারেক সময়। যতটুকু কাজে লাগানো যায় এরই প্রচেষ্টা।
হঠাৎ অনুভব করলাম পকেটে আমার মানিব্যাগটা নেই। চেয়ারের নিচে, আশপাশ, টেবিলের ওপর বই-খাতার ভিড়ে, কোথাও নেই। দ্রুত চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগলো। কোথায় হতে পারে? আমি কি সঙ্গেই আনিনি?
তখনই খেয়াল হলো লাইব্রেরির বারান্দায় বসে বাদামওয়ালাকে বাদামের দাম দিয়েছিলাম। পরে চলে আসার সময় বই আর ব্যাগের দিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে মানিব্যাগটা হয়তো পড়ে গিয়েছে সেখানেই বা আশপাশে।
দৌড়ে নিচে নামলাম। আমার বসার স্থান, এর আশপাশে, সব জায়গায় খুঁজলাম। পেলাম না। ব্যাগ জমা দেয়ার স্থান থেকে ব্যাগটা ফেরত নিলাম। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও এর ভেতর মানিব্যাগটা পেলাম না।
এবার দূরে ঐন্তিকে দেখলাম। মনে কিছু আশা আর সম্ভাবনার উকি-ঝুঁকি। কিন্তু না। তাকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম সেও দেখিনি।
একে একে সব সম্ভাবনার লাইট নিভে যাচ্ছে। চরম হতাশা গ্রাস করলো আমাকে।
মানিব্যাগের ভেতর আমার ইউনিভার্সিটির আইডি কার্ড, টাকা আরও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজ ছিল। টিউশনির কড়কড়ে ম্যাড়ম্যাড়ে যা-ই হোক, টাকার সংখ্যা বা পরিমাণ সে সময়ে আমার মতো একজন ছাত্রের জন্য মোটামুটি বড়োই ছিল। মানিব্যাগে ছিল সেকেন্ড ইয়ারে ভর্তির রিসিট যা একটি দরকারি দলিল। সবচেয়ে দরকারি ছিল আইডি কার্ডটি যা ছাত্র রাজনীতির দরুন প্রায়ই সংকীর্ণ হয়ে যাওয়া কোলাপসিবল গেইটের ভেতর প্রবেশ করতে প্রয়োজন হতো আমার মতো সাধারণ ছাত্রদের।
ঢাকা ইউনিভার্সিটির হলগুলোতে দুই ধরনের ছাত্রছাত্রী থাকে। এক. সাধারণ ছাত্র যারা নিজেকে অরাজনৈতিক, পড়–য়া, নির্বিরোধী, শান্ত পরিচয় দিতে অভ্যস্ত। মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে অহেতুক ঝামেলা থেকে দূরে থাকা। এবং দুই. ছাত্র নেতা আর কর্মী।
সাধারণ ছাত্রদের মাসের শুরুতে পুরো মাসের খাবার বিল বাবদ মেসে টাকা জমা দিতে হয়। এ চিন্তাটাও ঘুরপাক খেয়ে গেল মুহূর্তে। এমন বেকায়দা অবস্থায় আর পড়িনি। এদিকে আবার পরীক্ষার টেনশন।
হঠাৎ চোখে পড়লো দূরে কিছু টোকাই ঘুর ঘুর করছে। কারো হাতে চকোলেট, কারো হাতে সিগারেট। আমার ডাকে কয়েক টোকাই দৌড়ে এলো এবং হতাশ হলো এ জন্য যে, আমি কিছুই কিনছি না। কিন্তু কৌতুহলী হলো এ কারণে যে, আমি মূল্যবান একটা কিছু হারিয়েছি। আমার অনুরোধে তারা সারিবদ্ধভাবে বেশ কিছু জায়গায় খোঁজাখুজি করলো। এক পর্যায়ে শর্ত দিলাম, যে আমার মানিব্যাগ খুঁজে বা ফেরত দেবে তাকে একশ টাকা পুরস্কার দেবো। নিজের কথা নিজের কাছেই বোকা লাগলো পরক্ষণেই।
কোনো কারণে ধৈর্য হারিয়ে ফেলছিলাম। আজ বৃহস্পতিবার। আজ মানিব্যাগটা না পাওয়া গেলে আর পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এক সময় আমার মনে সন্দেহ জাগলো, টোকাইগুলোর মধ্যেই কেউ না কেউ মানিব্যাগটা নিয়ে থাকবে। সন্দেহ দূর করতে, নাকি নিজের মরিয়া হয়ে যাওয়ার কারণেই এক সময় বোধ করি সব বুদ্ধি লোপ পেল। সম্ভাব্য সবার পকেট চেক করলাম। টোকাইগুলোর সাবলীল ভাব দেখে নিজেকে আরও ছোটো মনে হলো।
লাইব্রেরি ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে আর আমি দুপুরে না খেয়ে মানিব্যাগ খুঁজছি।
টোকাইগুলোর কথা এরপরও বিশ্বাস হতে চাইছিল না। কিন্তু আমি নিরূপায়। সবচেয়ে সন্দেহ হলো দূরে দাড়ানো এক টোকাইকে। প্রথম থেকে খেয়াল করছি সে দূরত্ব বজায় রাখছে। তাকে ডাকলাম।
শান্ত-শিষ্ট চেহারা। গভীর কালো চোখ। ময়লা-ছেড়া জামা আর প্যান্ট। নোংরা হাতে লাভক্যান্ডির একটা প্যাকেট ধরা। এতে দশ পনেরোটা অবিক্রিত লাভক্যান্ডি।
তার নাম বেলাল। বয়স বড়োজোর আট। সঙ্গে তার ছোটো ভাই। তিন বা চার বছর বয়সী শিশুটা বড়ো ভাইয়ের প্যান্ট ধরে কাঁদছে। এতক্ষণ দূরে থাকায় কান্নার কারণ বুঝতে পারছিলাম না। এখন কাছে আসায় বুঝলাম, তার ক্ষিধে পেয়েছে, ভাত খেতে চায়।
বেলালকে জিজ্ঞাসা করলাম সে একটা মানিব্যাগ দেখেছে বা পেয়েছি কি না? না, বললো সে। তার পকেটও চেক করলাম। নেই। দুইটা বাজে। এর বেশিও হতে পারে। তিনটায় আমার টিউশনি। লাইব্রেরি চত্বর প্রায় ফাঁকা। ব্যাগ হাতে, ক্ষিধে পেটে মানিব্যাগ খুঁজছি, সঙ্গে সন্দেহভাজন কতিপয় টোকাই। তারা এদিকে ক্রমাগত কিচিরমিচির করে একজন আরেকজনকে বোঝাচ্ছে মানিব্যাগটা পেয়ে থাকলে তারা কী করতো, কী কৌশলে কত দ্রুত এর প্রাপকের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতো। কার এ রকম কতটা ইতিহাস আছে তাও বয়ান করলো।
বেলাল চুপচাপ। সে ওই হই হট্টগোলে যোগ দিচ্ছে না। দুই একবার শান্তভাবে আমাকে প্রশ্ন করলো, কীভাবে হারালো, কোথায় হারালো ইত্যাদি।
উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে সন্দেহভাজনরা একে একে আমার কব্জা থেকে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। আমিও আশা ছেড়ে দিয়েছি। ভাবলাম, তাদের জায়গায় থাকলে কুড়িয়ে পাওয়া কয়েক হাজার টাকাসহ একটা মানিব্যাগ ফিরিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তাও হয়তো করতাম না।
টিএসসির পথে অগ্রসর হলাম। যেকোনো একটা বাসে মগবাজারে টিউশনিতে যাব। বেলাল আর তার বিলাপরত ভাইটাও আমার সঙ্গে সঙ্গে আসছে। অন্য টোকাইগুলো ইতিমধ্যে সটকে পড়েছে। মনে মনে ভাবছি বেলালের কাছে মানিব্যাগটা থাকতে পারে যা সে এখন হয়তো ফেরত দেওয়ার কথা ভাবছে আবার নাও হতে পারে।
আমি যাত্রী ছাউনির নিচে বসে বাসের অপেক্ষায়। এক সময় উপলব্ধি করলাম ইতিমধ্যে বাসের সময় পার হয়ে গেছে। কারণ আজ বৃহস্পতিবার।
বেলালের দিকে তাকালাম। আমার পাশে বসে আছে পা ঝুলিয়ে। ভাইটা আগের মতোই ভাত খামু, ভাত খামু করছে। বেলালের শান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে শোনানের মতো করে বললাম, বাসের সময় পার হয়ে গেছে। মানিব্যাগটাও নেই যে, রিকশায় মগবাজার যাব।
সে কিছুই বললো না। কোনো চমকের আশা ছেড়ে দিলাম। চুপ করে আমার দুর্ভাগ্যের কথা ভাবছি।
এইচএসসি-তে ঢাকা বোর্ডে স্ট্যান্ড করায় গ্রাম থেকে ফেরার পথে মা খুশি হয়ে এক হাজার টাকা পুরস্কার দিয়েছিলেন যা ঢাকায় পৌঁছানোর পর মৌচাকের মোড়ে পকেটমার হয়ে যায়। আজ হারালাম এত টাকা আর প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ মানিব্যাগ।
বেলাল সারাদিনের ক্যান্ডি বিক্রির টাকাগুলো গুণছিল। ত্রিশ বা চল্লিশ টাকা হবে বড়োজোর। ভাবলাম, নিজেই দুপুরে কী খাবে আর ছোটো ভাইটাকেই বা কী খাওয়াবে! আমি হিসাববিজ্ঞানের ছাত্র। তবু এটুকু বুঝতে কষ্ট হয় না, এরপরও তাকে পুঁজি ধরে রাখতে হবে আগামীকালের ব্যবসার জন্য।
সূর্যটা হেলে পড়েছে। সপ্তাহান্তে এখানে রাস্তাঘাট ফাঁকা।
এমন সময় হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে বেলাল দুটি দশ টাকার নোট আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলো। বলল, এ টাকাটা রাখেন।
আমি কিছু বলার আগেই সে আবার বলল, আপনি এইটা দিয়ে মগবাজার যান।
তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, টাকাটা তোর কাছেই রাখ। আমার দরকার নেই, আমি ব্যবস্থা করে নেবো।
আমার সংকোচ দেখে রীতিমতো জোরাজুরি আরম্ভ করলো! না, না, কোনো সমস্যা নেই। আপনি চাইলে শনিবারে ফেরত দিয়ে দিয়েন। আমাকে লাইব্রেরির সামনেই পাবেন।
তার সরল চাহনির মুখে, দারিদ্র্যের সুস্পষ্ট চিহ্ন। তার ভাইয়ের ক্ষিধের কান্না আর ঘটনার আকস্মিকতায় আমার চোখে পানি চলে এলো। ভাবলাম একটু আগে যাকে চোর সন্দেহ করছিলাম সে আমার সংকীর্ণতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। তার সরলতা এবং মহত্ত্ব আমাকে জানিয়ে দিল কেন শিশুদের ফুলের মতো সরল বলে, কেন বলে ফেরেশতা।
আমি সামলে নিতে দ্রুত বিদায় নিয়ে সেখান থেকে চলে গেলাম। সেদিন জায়নামাজে বসে নিজের মানিব্যাগের সন্ধান দিতে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করিনি। প্রাণ ভরে দোয়া করেছি বেলালের জন্য। বেলাল দেখিয়েছে কীভাবে মানুষকে শর্তহীনভাবে, স্বার্থহীনভাবে, অকারণে, গায়ে পড়ে ভলোবাসা যায়, সাহায্য করা যায়।
মাসখানেক পরের কথা। সহপাঠী বন্ধু সুজন একদিন বলল, তোমার আইডি কার্ডের ফটোকপি সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে নোটিশ বোর্ডে ঝোলানো আছে।
দৌড়ে গেলাম সেন্ট্রাল লাইব্রেরি। পরিচয় দিয়ে কাউন্টার থেকে আমার হারানো পরিচয়পত্রটি সংগ্রহ করলাম। শশ্রুম-িত কাউন্টারের স্টাফ আবার জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি আরও কিছু হারিয়েছিলেন?
বললাম, জি, মানিব্যাগ। নিখুঁত বর্ণনা দিলাম। শরীরের ভেতর রক্ত কণিকারা ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছে।
স্মিতহাস্যে ড্রয়ার থেকে তিনি আমার হারানো মানিব্যাগটা বের করে দিলেন। চেক করে দেখলাম সব ঠিকঠাক আছে। ভদ্রলোক আরও বললেন, আপনার মানিব্যাগটা লাইব্রেরিয়ান অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম পেয়ে জমা দিয়ে গিয়েছেন।
বেলালকে ওই বৃহস্পতিবারের পর আর কখনো কোথাও দেখিনি। অনেকদিন পার হয়ে গেল। শুধু মাঝে একবার বিটিভি-তে সৈয়দ বোরহান কবিরের ‘পরিপ্রেক্ষিত’ অনুষ্ঠানের টোকাইদের নিয়ে করা পর্বে হঠাৎ তাকে কয়েক মুহূর্তের জন্য দেখেছিলাম। জীবনের লক্ষ্য কী? এ প্রশ্নের উত্তরে সে বলেছিল, ‘লক্ষ টাকার মালিক হইতে চাই।’
লেখক: জাতিসংঘের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ।
You must be logged in to post a comment.