কাজি নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) একটি বহুমুখী প্রতিভার নাম। গতানুগতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল পরিবারে জন্ম নিয়েও নজরুল স্বীয় প্রতিভাবলে তার সাহসী ও ক্ষুরধার লেখনি, বক্তৃতা এবং চিন্তায় বাংলার সমাজ সংস্কৃতি, রাজনীতি, ধর্ম নির্বিশেষে মানবতার ফেরিওয়ালা হয়ে বাংলা সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ করেন। নজরুলের আত্ম প্রকাশ ছিল ধুমকেতুর মত।
তিনি বাংলা সাহিত্য-সংগীত জগতে একজন কিংবদন্তী। শুধু সাহিত্য-সংগীতেই নয় রাজনীতি, সাংবাদিকতা, চলচ্চিত্রসহ সকল জগতে ছিল তার স্বচ্ছন্দ পদচারনা। মাত্র বাইশ-তেইশ বছরের ক্রিয়াশীল লেখনী সময়ে তিনি তার সাহিত্য চর্চায় কবিতা-গান-উপন্যাস-প্রবন্ধছোটগল্প-অনুবাদ-নাটক-নাটিকা ইত্যাদি রচনার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য সংগীতকে নিয়ে গেছেন এক উত্তুঙ্গ উচ্চতায়।
নজরুলের লেখনিতে স্থান পেয়েছিল সমসাময়িক সমাজ ও রাজনীতির নেতিবাচক রুপ এবং তার দ্ব্যর্থহীন প্রতিবাদ সর্বোপরি মানুষ এবং মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা ছিল মূল লক্ষ্য। তার সব্যসাচী দর্শনে সমাজের কোন একটি বিষয়ও তার কলমকে এড়িয়ে যেতে পারে নি। তিনি শুধু মানুষের জাগতিক চাহিদাকেই বিবেচনা করেছেন এমনটি নয় বরং তিনি মানুষের আধ্যাত্বিক বিষযটিকেও সমভাবে তুলে এনেছেন তার কলম ও কালির খোরাক হিসেবে। সমসাময়িক সময়ে সমাজে বিরাজমান দুটি জাতি-হিন্দু ও মুসলিম, উভয়ের ধর্মীয় বিষয়টি গভিরভাবে উপলব্ধি ও উপস্থাপিত হয়েছে নজরুলের গান ও কবিতায়। উভয় ধর্মের ক্ষেত্রে তিনিই একমাত্র কবি যিনি রচনা করেছেন সংগীত ও কবিতা। বিশেষ করে মুসলিম ধর্মীয় বিষয়ে ইসলামের মৌলিকত্বকে ধারন করে রচনা করেছেন অসংখ্য গানও কবিতা।
আরও পড়ুন : শবে কদরের খোঁজে আল আকসায় মুসুল্লিদের ঢল
ইসলামের মৌলিক শিক্ষা হলো মানবতার মুক্তির মাধ্যমে একটি শোষনমুক্ত বাসযোগ্য মানব সমাজ বিনির্মান। পবিত্র ক্বোরআনের অলোচ্য বিষয় হলো মানুষ এবং ক্বোরআন নাযিলের উদ্দেশ্য হলো মানুষের কল্যাণ ও অকল্যাণের দিক নির্দেশনা প্রদান। কাজি নজরুলের প্রতিটি ইসলামী কবিতা, গান, পবিত্র ক্বোরআনের মৌলিক আহবানের প্রতিফলন। নজরুল যদিও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় অতটা উচুতে পৌছতে পারে নাই তথাপিও ইসলামের মৌলিক বিষয়ের স্বচ্ছ জ্ঞান, সমসাময়িক বিশ্ব, অপরাপর সাহিত্য কর্মের উপর সম্যক ধারনা, অত্যন্ত গভিরভাবে তিনি অর্জন করেছিলেন। তাইতো তিনি রচনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন সমাজ, সংস্কৃতি, ধমর্, দর্শনসহ সকল বিষয়ের উপর কালজয়ী গান, কবিতা বা গল্প। নজরুলের ইসলামী গান ও কবিতা খুবই সমৃদ্ধ। তিনি আল্লাহর একতব¡ াদ থেকে শুরু করে রেসালাত, পুলসেরাত অর্থ্যাৎ আখেরাত, নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, ঈদ, মহররম ইত্যাদি বিষয়ে সমানভাবে গান ও কবিতা রচনা করেছেন। এমনকি তিনি পবিত্র ক্বোরআনের আমপারার (৩০ পারা) কাব্যিক অনুবাদও করেছেন। ইসলামের উপর নজরুলের লেখা গান, কবিতা ও বক্তৃতা হয়ে উঠেছে ক্বোরআন ও হাদিসে বর্নিত বা নির্দেশিত বিষয়সমুহের কাব্যিক ব্যাখ্যা। যেভাবে তার অসংখ্য রচনার (গান ও কবিতা) মধ্যে পাওয়া যায় ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য ও মান্য বিষয় যাকাত, দান ও সদকা। ইসলাম সকল ক্ষেত্রের মত সমাজে যেভাবে অর্থনৈতিক ভারসাম্যের জন্য জাকাত আদায়, বেশি বেশি দান-সদকা করা সামর্থবানদের জন্য অবশ্য পালনীয় বা অত্যন্ত উচু মানের কল্যাণকর কাজ বলে নির্দেশ দিয়েছেন সেই বিষয়টি নজরুল তার কাব্যিক ঢঙে মাত্র গুটি কতেক লাইনে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যা অনেক বক্তব্য বা বিবৃতি দিয়েও প্রকাশ করা অসম্ভব। যেমন জাকাতের ক্ষেত্রে আমরা দেখি:
বুক খালি করে আপনারে আজ দাও জাকাত,
করো না হিসাবি আজ হিসেবের অঙ্কপাত!
একদিন করো ভূল হিসাব।
এখানে নজরুল ইসলামী শরিয়াতের এই গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক এবাদাতের ক্ষেত্রে উদার হয়ে কোন হিসাব ছাড়াই বা ভ‚ল হিসাব করে বরং পরিমানের থেকে বেশী প্রদানের জন্য আহবান করেছেন। মুলত ইসলাম ধর্মের প্রতিটি বিধান পৃথিবী এবং মানুষের জন্য উপকারী এবং সেসবের মধ্যে জাকাত অন্যতম। জাকাত ধনীর অর্থবৈভবে গরিবের অধিকার নিশ্চিত করে। ধনী-গরিবের মধ্যে তৈরি করে সম্প্রীতির সেতুবন্ধন। সমাজে তৈরি করে সাম্যের চিত্র। ইসলামের সাম্য ও অর্থনৈতিক এই ভারসাম্যের ক্ষেত্রেও নজরুলের ভাবনা এবং তার কলম ছিল নিখুত ও ক্ষুরধার-
ইসলাম বলে, সকলের তরে মোরা সবাই,
সুখ-দুখ সম-ভাগ করে নেব সবাই ভাই,
নাই অধিকার সঞ্চয়ের!
কারো আঁখি-জলে কারো ঝাড়ে কি রে জ্বলিবে দীপ?
দু’জনার হবে বদনসিব, লাখে লাখে হবে বদনসিব?
এ নহে বিধান ইসলামের।
ইসলামী শরিয়াতের অন্যতম স্তম্ভ হলো জাকাত এবং এ ব্যাপারে পবিত্র ক্বোরআনে অসংখ্যবার এর ফজিলাত এবং এর সামাজিক ও মানবিক কল্যাণের দিক নির্দেশ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন: “নিশ্চয় মুত্তাকিরা থাকবে জান্নাতসমূহে ও ঝর্ণাধারায়, তাদের রব তাদের যা দিবেন তা তারা খুশীতে গ্রহণকারী হবে। ইতোপূর্বে এরাই ছিল সৎকর্মশীল। রাতের সামান্য অংশই এরা ঘুমিয়ে কাটাতো। আর রাতের শেষ প্রহরে এরা ক্ষমা চাওয়ায় রত থাকত। আর তাদের সম্পদে রয়েছে প্রার্থী ও বঞ্চিতের হক” [আযযারিয়াত, ১৫-১৯]। পবিত্র ক্বোরআনের বাণী, “আর তাদের সম্পদে রয়েছে প্রার্থী ও বঞ্চিতের হক,” বিষয়টি নজরুল তার কবিতায় ভিন্ন রঙে অল্প কথায় অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে উপস্থাপন করেছেন “বঞ্চিতের হকই আল্লাহর হক” হিসাবে :
ভেবো না, ভিক্ষা চাহি মোরা, নহে শিক্ষা এ আল্লার, মোরা প্রতিষ্ঠা করিতে এসেছি আল্লার অধিকার!
একইভাবে অন্য লাইনসমূহে আমরা দেখতে পাই ডাকাত যেমন কোন জিনিষ জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেই তেমনি রুপক অর্থে জাকাত আদায়ে আল্লাহর হুকুমের ওজন বোঝাতে নজরুল জাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে ডাকাতের উপমা নিয়ে এসেছেন:
ডাকাত এসেছে জাকাত লইতে, খোলো বাক্সের চাবি,
আমাদের নহে, আল্লাহর দেয়া ইহা মানুষের দাবি। পবিত্র ক্বোরআনে আল্লাহ বলেন: “যারা সোনা ও রূপা পুঞ্জীভূত করে রাখে এবং তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না, তুমি তাদেরকে বেদনাদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও” [সূরা আত-তাওবাহ, ৩৪]। অন্য আয়াতে বলেন: “আল্লাহ যাদেরকে তার অনুগ্রহ থেকে যা দান করেছেন তা নিয়ে যারা কৃপণতা করে তারা যেন ধারণা না করে যে, তা তাদের জন্য কল্যাণকর, বরং তা তাদের জন্য অকল্যাণকর, যা নিয়ে তারা কৃপণতা করেছিল, কিয়ামত দিবসে তা দিয়ে তাদের বেড়ি পরানো হবে” [সূরা আল ইমরান, ১৮]।
আল্লাহ কতৃর্ক সম্পদ জমাকারীদের ব্যাপারে যে শাস্তির হুসিয়ারি করা হয়েছে, নজরুল সেই একই বিষয় কাব্যিক ব্যাখায় মানবমনে জোরালোভাবে আঘাত করে সম্বিত ফিরিয়ে দেয়ার কাজটি করেছেন: বাঁচিবে না আর বেশি দিন রাক্ষস লোভী বর্বর, টলেছে খোদার আসন টলেছে, আল্লাহু-আকবর! সাত আসমান বিদারি আসিছে তাহার পূর্ণ ক্রোধ, জালিমে মারিয়া করিবেন মজলুমের প্রাপ্য শোধ।
ব্যাক্তির পাশাপাশি ইসলাম রাষ্ট্রীয়ভাবেও জাকাত প্রদানের ব্যাপারেও চুড়ান্ত ফয়সালা প্রদান করেছেন। আল্লাহ বলেন: “আমি যদি তাদেরকে পৃথিবীতে রাজত্ব দান করি, তাহলে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, সৎকাজের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজ হতে বিরত রাখবে, আর সব কাজের চূড়ান্ত পরিণতি একান্তই আল্লাহর ইচ্ছাধীন” (সূরা হাজ্জ, ৪১)। পবিত্র ক্বোরআনের পাশাপাশি রসুল (সা.) এর অসংখ্য হাদীস দ্বারা জাকাতের গুরুত্ব এমনকি জাকাত প্রদান বা আদায়ের আবশ্যকতা প্রদান করা হয়েছে। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, মু‘আয ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহুকে ইয়ামান পাঠানোর সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেন : “তুমি কিতাবিদের এক কওমের নিকট যাচ্ছ, অতএব, তাদেরকে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও আমি আল্লাহর রাসূল’ সাক্ষীর দিকে আহ্বান কর, যদি তারা এতে আনুগত্য প্রকাশ করে, তাদেরকে জানিয়ে দাও যে, প্রত্যেক দিন ও রাতে আল্লাহ তাদের ওপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। যদি তারা এতে আনুগত্য প্রকাশ করে, তাদেরকে জানিয়ে দাও যে, আল্লাহ তাদের ওপর সদকা ফরয করেছেন, যা তাদের ধনীদের থেকে গ্রহণ করে তাদেরই গরীবদের মাঝে বণ্টন করা হবে, যদি তারা এতে আনুগত্য প্রকাশ করে, তুমি তাদের দামী সম্পদ গ্রহণ করা পরিহার কর, আর মজলুমের দো’আ থেকে বাঁচ। কারণ, তার মাঝে ও আল্লাহর মাঝে কোনো পর্দা নেই”(সহীয়াইন)।
অন্য হাদীসে এসেছে-ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, “আবূ সুফইয়ান (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস উল্লেখ করে বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে সালাত (প্রতিষ্ঠা করা), যাকাত (আদায় করা), আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা ও পবিত্রতা রক্ষা করার আদেশ দেন”। অন্য হাদীসে বর্নিত হয়েছে- “আবূ বাকর (রাঃ) বললেন, আল্লাহর শপথ! তাদের বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই আমি যুদ্ধ করবো যারা সালাত ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করবে, কেননা যাকাত হল সম্পদের উপর আরোপিত হক্ব। আল্লাহর কসম। যদি তারা একটি মেষ শাবক যাকাত দিতেও অস্বীকৃতি জানায় যা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর কাছে তারা দিত, তাহলে যাকাত না দেয়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে আমি অবশ্যই যুদ্ধ করবো। হযরত উমার (রাঃ) বলেন, আল্লাহর কসম, আল্লাহ আবূ বাকর (রাঃ)-এর হৃদয় বিশেষ জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত করেছেন বিধায় তাঁর এ দৃঢ়তা, এতে আমি বুঝতে পারলাম তাঁর সিদ্ধান্তই যথার্থ” (সহিহ বুখারি-১৪০০, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৩০৯ শেষাংশ, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৩১৫ শেষাংশ)। জাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে ইসলামের ১ম ও ২য় খলিফার উপরোক্ত যুদ্ধ ঘোসনা নজরুল মননে ভিন্নরুপে চিত্রিত হয়েছে। তিনি তার কবিতায় এ যুদ্ধের রসদ হিসেবে ঈদের বাকা চাঁদকেই যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের হুমকি দিয়েছেন:
তাঁরই ইচ্ছায়―ব্যাঙ্কের দিকে চেয়ো না―ঊর্ধ্বে চাহো, ধরার ললাটে ঘনায় ঘোলাটে প্রলয়ের বারিবাহ!
আল্লার ঋণ শোধ করো, যদি বাঁচিবার থাকে সাধ ; আমাদের বাঁকা ছুরি আঁকা দেখো আকাশে ঈদের চাঁদ!
তোমারে নাশিতে চাষার কাস্তে কী রূপ ধরেছে, দেখো,
চাঁদ নয়, ও যে তোমার গলার ফাঁদ! দেখে মনে রেখো!
মূলতঃ জাকাত একটি মৌলিক ইবাদাত যাতে প্রদানকারী এবং গ্রহণকরী উভয়ের কল্যাণ নিহিত আছে। ইসলামী শরিয়তে রমজান মাস হলো যে কোন কল্যানমূলক কাজ করার মাস এবং যে কারনে এই মাসে সকলের দান-সদকা, জাকাত-ফিদিয়া (ফিতরা) দেয়ার ব্যাপারে জোরালোভাবে উ™ুদ্ধ¢ করা হয়েছে। তাছাড়া জাকাত দান নয় বরং বিত্তবানদের সম্পদে বিত্তহীনদের অধিকার। আর এই জনকল্যাণমূখী ইসলামী তাকিদের ব্যাপারে কাজি নজরুল ছিলেন উচ্চকন্ঠি, যা তার কবিতা ও গানে অনুরণিত হয়েছে বারবার। নজরুল তার কবিতায় বলেন:
মোরা শুধু জানি, যার ঘরে ধনরত্ন জমানো আছে,
ঈদ আসিয়াছে, জাকাত আদায় করিব তাদের কাছে।
এসেছি ডাকাত জাকাত লইতে, পেয়েছি তাঁর হুকুম,
কেন মোরা ক্ষুধা-তৃষ্ণায় মরিব, সহিব এই জুলুম?
জাকাতের বিধান যে মহান রব কর্তৃক সামর্থবানদের উপর অবশ্য করনীয় এবং একই সাথে জাকাত আদায় না করা বিত্তশালীদের পরিণাম সম্পর্কে আল্লাহর ঘোসনা নজরুল কাব্যে অত্যন্ত অর্থবহভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে:
যক্ষের মতো লক্ষ লক্ষ টাকা জমাইয়া যারা খোদার সৃষ্ট কাঙালে জাকাত দেয় না, মরিবে তারা।
ইহা আমাদের ক্রোধ নহে, ইহা আল্লার অভিশাপ,
অর্থের নামে জমেছে তোমার ব্যাঙ্কে বিপুল পাপ।
যেহেতু রমজান মাসে জাকাত প্রদান করা উত্তম তাই এই মাসের যেকোনো একটি দিনকে বছরের সমাপনী দিন ধরে জাকাতযোগ্য খাতের সব সম্পদের হিসাব করে জাকাত নির্ধারণ ও আদায় কমরা উত্তম। এর মুল উদ্দেশ্যই হলো ধনীর সঙ্গে গরিবের আনন্দ ভাগাভাগি করা। একইসাথে এই রমজান মাসের সাদকায়ে ফিতর হলো-রোজা খোলার সাদকা বা দান। সাদকায়ে ফিতর এমন দানকে বলা হয়, যা পুরো রমজান মাস রোজা রাখার পর ঈদের দিন সব সামর্থ্যবানদের জন্য আদায় করা আবশ্যক। এ বিশেষ দান দিয়েই গরিব-অসহায় মানুষ ঈদের আনন্দে মেতে উঠবে এটাই উদ্দেশ্য। নজরুল তার কবিতা ও গানে রমজানের শেষে ঈদের চাঁদ উঠার সাথে অসহায় গরিবদের ঈদকে খুশিতে পরিণত করার তাকিদ অনুভব করে শরিয়তের মূল বিষয়কে সামনে রেখে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী, আবেদনময়ীভাবে আবার কখনো কঠোর ভাষায় আহবান করেছেন। নজরুলের ঈদের চাঁদ কবিতায় এই বিষয়টিই প্রগাঢ়রুপে প্রতিভাত হয়েছে: সিঁড়ি-ওয়ালাদের দুয়ারে এসেছে আজ চাষা মজুর ও বিড়িওয়ালা; মোদের হিস্সা আদায় করিতে ঈদে দিল হুকুম আল্লাতালা!
দ্বার খোলো সাততলা বাড়িওয়ালা, দেখ কারা দান চাহে,
মোদের প্রাপ্য নাহি দিলে যেতে নাহি দেবো ঈদগাহে।
আবার নজরূলের “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে” গানে নজরুল যে আহবান করেছেন সেখানে আছে প্রগাঢ় আবেদন যা মানুষের হৃদয়কে দারুণভাবে ছুয়ে গেছে:
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।
তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ
দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ
————— যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী সেই গরীব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ।
নজরুল কাব্যে একইভাবে ঈদকেও মানবতার বা বঞ্চিতের ঈদ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেহেতু বিত্তবানগণ সারা বছর ধরেই তাদের বিত্ত বৈভবের মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করে কিন্তু বঞ্চিতগণ, যাদেরকে নজরুল কখনো প্রজা আবার কখনো কৃষক বা গরিব, মিসকিন হিসাবে তার কাব্য বা গানে নিয়ে এসেছেন, তারা শুধু ঈদের দিনই আল্লাহ কতৃর্ক ঘোসিত বিত্তবানদের সম্পদে তাদের অধিকারপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন, তাইতো মানবতার নজরুল এই বিষয়টিকে খুবই জোরালো ভাবে সামনে নিয়ে এসেছেন। তিনি শুধু ঈদ বা ঈদের চাঁদকে নিয়ে একাধীক গান ও কবিতা রচনা করেছেন যার সবগুলোর মর্মার্থ হলো বঞ্চিতদের অধিকার আদায় ও তাদের মুখের এক চিলতে হাসি। তিনি লিখেছেন: প্রজারাই রোজ রোজা রাখিয়াছে, আজীবন উপবাসী, তাহাদেরই তরে এই রহমত , ঈদের চাঁদের হাসি। শুধু প্রজাদের জমায়েত হবে আজিকার ঈদ্গাহে, কাহার সাধ্য, কোন ভোগী রাক্ষস সেথা যেতে চাহে?
একইসাথে নজরুলের অভিযোগ সেই ঈমামদের উপর যারা ঈদগাহে ঈমামতি করেন কিন্তু বঞ্চিতদের অধিকার নিয়ে কথা বলার সাহস দেখান না। তাদের ব্যাপারে নজরুল সন্দেহ পোষন করেন যে তারা আসলেই কি ক্বোরান-হাদীস পড়ে কোন কিছু বুঝেছে অথবা নামায-রোজা তাদের জীবনে কোন অর্থবহ পরিবর্তন আনতে পেরেছে? তিনি তার কৃষকের ঈদ কবিতায় সেই প্রশ œ ছুড়ে দিয়েছেন:
জরির পোশাকে শরীর ঢাকিয়া ধনীরা এসেছে সেথা, এই ঈদ্গাহে তুমি কি ইমাম, তুমি কি এদেরই নেতা? নিঙাড়ি কোরান হাদিস ও ফেকা, এই মৃতদের মুখে অমৃত কখনও দিয়াছ কি তুমি? হাত দিয়ে বলো বুকে। নামাজ পড়েছ, পড়েছ কোরান, রোজাও রেখেছ জানি, হায় তোতাপাখি! শক্তি দিতে কি পেরেছ একটুখানি? ফল বহিয়াছ, পাওনিকো রস, হায় রে ফলের ঝুড়ি, লক্ষ বছর ঝরনায় ডুবে রস পায় নাকো নুড়ি!
ইসলামে দুটি দিনকে খুশির দিন হিসাবে ঘোসনা করা হয়েছে আর তা হলো দুই ঈদের দিন। এই ঘোসনার মর্মার্থ হলো যেহেতু উভয় ঈদেই আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী ধনীদের সম্পদে গরিবদের অধিকার নিহিত থাকে এবং এই দুই ঈদেই তা আদায়ের
তাকিদ দেয়া হয়েছে এবং সেই কারনেই সমাজের সবার মুখেই হাসি থাকবে, থাকবে না অপ্রাপ্তির কোন আক্ষেপ এবং একই কারনেই এই দুটি দিনকে খুশির দিন বলা হচ্ছে। কিন্ত সমাজে ইসলাম নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী জাকাত সদকা আদায় না হওয়া ও সুসম বন্টনের অভাবে এক ধরনের অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকেই যাচ্ছে যা নজরুল মননে দারুনভাবে ক্ষত সৃষ্টি করেছে, তাইতো তিনি তার কলমে গজের্ উঠেছেন এবং একই সাথে সেই ঈদের পানে চেয়েছেন যে ঈদে উচু-নীচু, ধনী-গরিব একসাথে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে পারবেন এবং তিনি এমন একজন রাহবারের তাকিদ অনুভব করেছেন যিনি এসে সেই মহান কাজটি করবেন। দীন কাঙালের ঘরে ঘরে আজ দেবে যে নব তাকিদ কোথা সে মহান শক্তি-সাধক আনিবে যে পুন ঈদ? ছিনিয়া আনিবে আশমান থেকে ঈদের চাঁদের হাসি ফুরাবে না কভু যে হাসি জীবনে, কখনও হবে না বাসি! সমাধির মাঝে গণিতেছি দিন, আসিবেন তিনি কবে?
রোজা এফতার করিব সকলে, সেই দিন ঈদ হবে।
নজরুল হয়ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার তেমন কোন সনদধারী নন কিš ‘ প্রতিভাধর নজরুল তার প্রতিভার স্ফুরণ ঘটাতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোন পরোয়া করে নি এবং যে কারনে তিনি একজন নজরুল। সাধারনতঃ যে কোন ব্যাক্তি ইসলামী শরিয়াতের উপর দীর্ঘ গবেষনার পর এর কোন বিধিবিধানের উপর বক্তব্য প্রদান করেন। কিন্তু নজরুল সেই বিষযগুলোতেই অত্যন্ত বিজ্ঞতার সাথে এবং এর নিরেট আবেদন অক্ষুন্ন রেখে অকপটে লিখে গেছেন যেভাবে তিনি লিখেছেন জাকাত, দান-সদকা ও ঈদ নিয়ে। মক্তবপড়ুয়া নজরুলের ইসলমী বিধিবিধানের মৌলিক কোন বিষয়ের উপর সাবলিল কিন্তু অর্থবহ লেখা সংশিষ্টø বিষয়ে তার গভির জ্ঞান এবং নজরুল মননে ইসলামের প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসা ও শ্রদ্ধার বহি:প্রকাশ বটে। ইসলাম মানবতার মুক্তির বিধান, এই শ্বাশ্বত ব্রত ধারন করে নজরুল গেয়ে গেছেন মানবতার জয়গান: গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নই, নহে কিছু মহিয়ান।
লেখক
সহযোগী অধ্যাপক
ভাষা ও যোগাযোগ বিভাগ
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।