হারিয়ে যাওয়া মোহামেডানীদের সালতামামি…

অন্যদৃষ্টি অনলাইন
শুক্রবার, ১৯ জুলাই, ২০১৯, ৯:৪২ অপরাহ্ন
চল্লিশ দশকে কলকাতা মোহামেডানের খেলোয়াড়বৃন্দ....

।। এলিস হক ।।

ব্যাকগ্রাউন্ড জানা দরকার। ঊনিশ শতকের শুরু থেকেই শহরতলীতে, শহরে-শহরে, গ্রামে-গ্রামে ফুটবল খেলা তার শাখা-প্রশাখা প্রসারিত করে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি গন্ডগ্রামের সাধারণ মানুষও ফুটবল খেলতে বাতাবি লেবু বা রাবারের বল বানিয়ে মাঠে নামতো।

উনিশ শতকে ফুটবল মূলত সাহেব ও তাদের সেনা ছাউনীর সীমানাবন্দী থেকে কচ্ছপ গতিতে এগিয়েছে। এখানে ভারতীয়দের বঞ্চনারও একটা করুণ ইতিহাস আছে।বর্ণবিদ্বেষী ইংরেজরা নিজেদের খেলা বলে ফুটবল থেকে ভারতীয়দের যতোটা পারতো দূরে ঠেলে দিয়েছিল। তবে তা সত্ত্বেও এই খেলাটি দিনে দিনে শ্বেতাঙ্গ বাবুদের সেই সীমানার দেয়াল টপকে ধরা দেয় ভারতীয়দের কাছে।

পরে আস্তে আস্তে ফুটবলকে ঘিরে গড়ে ওঠে ছোট-বড় ক্লাব। একথা তো সকলেরই জানা যে, বৃটিশ শাসনামলে এদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা-খেলাধুলা সবকিছুই ছিলো হিন্দুদের দখলে। আর তাদের এই আধিপত্যের মুখে মুসলিম সম্প্রদায় ছিলো বড়ই অসহায়। আর যার কারণে বৃটিশদের পর ফুটবল ছিলো হিন্দুদের পায়ে। এটা ধ্রুব্য সত্য ঘটনা।

উনিশ শতকের শেষ দশকে জন্মলাভ করা কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ফুটবলকে মুসলিম শিবিরে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলো। কারো কারো মতে, এ ক্লাবটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই তৎকালীন বাংলার পূর্বাঞ্চলে ফুটবলের ফরোয়ার্ড মার্চ শুরু হয়। দিনে দিনে এই অঞ্চলের অনেক স্থানে মোহামেডানের বহু ইউনিট জন্ম নিয়েছিলো।

গেলো শতাব্দীর বিশের দশকে প্রতিষ্ঠিত অনেক ইউনিটের একটি হলো কুমিল্লা মোহামেডান। শুধু কি তাই, সে সময়ে মুসলমানের রাজনৈতিক উত্থানের পেছনেও রয়েছে ফুটবল এবং এই ক্লাবের একটা বিশেষ ভূমিকা।

বৃটিশদের কু-শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে যখন ভারতীয়দের মধ্যে আন্দোলন দানা বাঁধছিলো। ভারতীয় রাজনীতির তাওয়া যখন ক্রমেই উত্তপ্ত হচ্ছিলো সে সময় নবাবজাদা আজিজুল ইসলাম ফুটবলের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা দেখে এবং মুসলমান সমাজকে ফুটবলের প্রতি আকৃষ্ট করতে অর্থাৎ ১৮৮৭ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো জুবিলী ক্লাব।

পরে এই ক্লাবটির নাম দু’বার পরিবর্তিত হয়েছে। প্রথমে ক্রিসেন্ট ক্লাব ও পরে হামিদিয়া ক্লাব। এই ক্লাবটি সর্বশেষ ১৮৯১ সালে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব নামধারণ করে নতুন পথে যাত্রা শুরু করেছে। তবে প্রথম দিকে এ যাত্রা পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিলো না। কী করুণ ইতিহাস!

আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে শুধু নামের অস্তিত্ব নিয়েই ক্লাবটিকে চলতে হয় প্রায় তিনটি দশক। মূলত এরপরই শুরু হয় অবিস্মরণীয় ইতিহাস রচনার পালা।

মুখে যতোই বলি না কেনো যে, খেলাধুলার সাথে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। বাস্তব সত্যি হচ্ছে-ক্রীড়াক্ষেত্রে রাজনীতির একটা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ প্রভাব সবসময় ছিলো, এখনো আছে।

ভুলে যাওয়া উচিত নয়, গত শতাব্দীর বিশের দশক থেকেই ভারতবর্ষে কংগ্রেস খেলাফত আন্দোলন, চট্টগ্রামে অস্ত্রাগার লুটসহ উত্তপ্ত নানা রাজনৈতিক কর্মকান্ডের প্রেক্ষাপটে হিন্দু ও মুসলিম দুই সম্প্রদায় স্বতন্ত্র আবাসভূমির দাবিতে যখন সোচ্চার হয়ে ওঠে। সে সময় কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব কলকাতা ফুটবল লীগের দ্বিতীয় বিভাগ থেকে চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রথম বিভাগে উন্নীত হয় এবং এখান থেকেই শুরু হয় তাদের লাগাতার বিজয় যাত্রা।

’৩৫ থেকে ’৩৮ টানা পাঁচ বছর এই ক্লাবটি কলকাতা লীগে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করলে মুসলমানদের মধ্যে নবজাগরণের সৃষ্টি হয় এবং মুসলমানদের এই নবজাগরণ তাদের রাজনৈতিক আন্দোলনকে বেগবান করতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলো।

অপরদিকে মোহামেডানের এই অভূতপূর্ব সাফল্যে ঈর্ষান্বিত মৌলবাদী হিন্দু সম্প্রদায় বিচলিত হয়ে পড়ে। তারা সোচ্চার হয়ে ওঠে মোহামেডান তথা মুসলমানদের অগ্রগতি রুখতে। এ লক্ষ্যে তাদের একটা অংশ নানা অপকর্ম এবং অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়েছিলো।

তারা ক্লাবটির বিরুদ্ধে ইংরেজদেরও ক্ষেপিয়ে তোলে। এক সময় ইংরেজরা ক্লাবটিকে ‘ইংরেজ বিরোধী ঘাঁটি’ হিসেবে চিহিৃত করে এর খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের ওপর নানা নির্যাতনের মাধ্যমে দমন নীতি প্রয়োগ করে।

তথ্য ঘেঁটে জানা গেছে, বৃটিশদের কবল থেকে নিজেকে রক্ষা করতে এই মোহামেডান ক্লাবে একবার আশ্রয় নিয়েছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এখানে আত্মগোপন করে থাকার সময় তিনি মোহামেডানকে নিয়ে একটা গানও লিখেছিলেন। নজরুলের প্রসঙ্গ যখন এলোই তখন এখানে তার আর একটি পরিচয়ের কথা না লিখলেই নয়। নজরুলের এ পরিচয়টা অনেকেরই অজানা। কাজী নজরুলও একসময় ফুটবল জগতের একজন ছিলেন।

কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে স্মৃতিচারণকালে তৎকালীন মুসলমানদের প্রথম পত্রিকা সওগাতের সম্পাদক নাসিরউদ্দিন বলেছিলেন, ‘নজরুলের বয়স যখন ৭/৮ বছর তখন তার সঙ্গে আমার পরিচয়। নজরুলকে আমি ফুটবল এবং দাবা খেলতে দেখেছি। তবে ও আড্ডা মারতে বেশি পছন্দ করতেন।

সে যাই হোক, মুসলিম সমাজে ফুটবলের জাগরণের স্রষ্টা কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব বিভিন্ন সময়ে নানা বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি হলেও সাফল্যের ঝান্ডা কখনোই তাদের হস্তচ্যুত হয়নি। গত শতকের সত্তর দশক পর্যন্ত এই দলটি ভারতীয় ফুটবলে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করেছিলো।

যাহোক-কুড়ি শতকের শুরু থেকেই কলকাতার ফুটবলাঙ্গনে সামাদের মতো ফুটবল যাদুকর আসেন। সামাদ বল নিয়ে ছুটলেই ধরে নেয়া হতো ‘নির্ঘাৎ গোল। তবুও ফুটবল লীগের খেলায় ভারতীয়রা অনেক পিছিয়েছিলো। বড়ই দুর্দিনের মধ্যেও কলকাতার ফুটবল লীগ ৩টি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল ১ম, ২য় ও ৩য় বিভাগ। দ্বিতীয় বিভাগ লীগে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ফুটবল খেলেছিলো বেশ কয়েক বছর ধরে।

১৯৩৩ সালে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দেশের এক তরুণ ফুটবল খেলোয়াড় কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে যোগ দেন। যার দু’পাই..দু’পাই এই খেলোয়াড়ের চমৎকার নৈপূণ্য চলতো। গোলের দিকে কিক নিলেই গোল। ফুটবল লীগ শেষ হলে দেখা গেলো, মোহামেডানের অবস্থান দ্বিতীয় বিভাগের শীর্ষে।

চুন্না রশিদ নামে এক নয়া ফুটবল খেলোয়াড় কলকাতা মোহামেডানের পক্ষে একাই ৩২টি গোল করেছিলেন। নিয়মিত ফুটবল খেলোয়াড় না হলেও হাবিবুল্লাহ বাহার তখন ছিলেন দলীয় অধিনায়ক। মোহামেডান হঠাৎ করে ১ম বিভাগ ফুটবল লীগে উঠলে কলকাতাগামী সমস্ত মুসলমানেরা এতোই অবাক হয়ে যান।

ঢাকার গভর্ণর খাজা নাজিমউদ্দিনকে নিয়ে সভাপতি করে মোহামেডানকে শক্তিশালী গড়ার লক্ষ্যে কমিটি গঠিত হয়েছিলো। মোহামেডানকে সুসংগঠিত করার জন্য ভারতের বাঙ্গালোর হতে রাইট ইন রহমত, নূর মোহাম্মদ, রাইট হাফব্যাকে মাসুম, লেফট হাফ ব্যাকে খোরশেদ আনোয়ার, শফি ও গোলরক্ষক তসলিম উদ্দিনকে দলে ভিড়িয়ে আনা হয়।

প্রথম খেলায় কলকাতা মোহামেডান ৩-০ গোলে শক্তিশালী বিদেশ দলকে হারিয়ে ভারতবাসীকে দারুণভাবে তাক লাগায়। ঐ খেলায় হাফিজ রশিদের জোড়া পা হতে ২টি গোল আসে। শুধু তাই নয়, মোহামেডান পরবর্তী খেলায় ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়ে দেয়।প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব প্রথম ভারতীয় দল হিসেবে জিতেছিলো।

প্রচন্ড ভিড়। দুপুর হতেই টিকিট কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। সেইদিনের অবস্থা কী সাংঘাতিক ভিড় ছিলো!

কলকাতা মোহামেডান যখন কোনো খেলায় জয়ী হতো, সেদিনই সারা কলকাতার মানুষের মধ্যে প্রবল উত্তেজনা দেখা যেতো। আকাশ বাণী কলকাতা হতে রিলে করে বেতারে ধারাভাষ্য সম্প্রচারিত হতো। আনন্দের রেশ ঢল পড়ে যেতো!

তারপর কয়েক বছর ধরে সেই একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি।

১৯৩৪ সালে প্রথম ভারতীয় দল হিসেবে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব লীগ চ্যাম্পিয়ন হ’বার আগেই ইস্টবেঙ্গল এই সম্মাণ পেতে পারতো। একবার নয়, ৩ বার চ্যাম্পিয়নশীপের পূর্ণ পেয়ালা তাদের ঠোঁটের কাছ হতে মাঠের মাটিতে পড়েছিলো।

১৯৩৪-৩৮ টানা ৫ বছর এবং ১৯৩৯ সাল বাদে পরপর আরো ২ বছর লীগ চ্যাম্পিয়ন এবং ঐ সময়ের মধ্যে ৩ বার শীল্ড জয়ের পর কলকাতা মোহামেডান দলের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ে যখন ভাটার টান পড়ে, তখন মাঠে-ময়দানে বেশি রমরমা ছিলো।ঐ ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগান লড়াইকে কেন্দ্র করে।

কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব কলকাতা ফুটবল লীগে ১১ বার চ্যাম্পিয়নের খেতাব পেয়েছে। বছরগুলো হলো-১৯৩৪, ১৯৩৫, ১৯৩৬, ১৯৩৭, ১৯৩৮, ১৯৪০, ১৯৪১, ১৯৪৮, ১৯৫৭, ১৯৬৭, ১৯৮১ সাল।

৯ বার তারা লীগ রানার্স আপ হয়েছে এ পর্যন্ত-১৯৪২, ১৯৪৪, ১৯৪৯, ১৯৬০, ১৯৭১, ১৯৯২, ২০০২, ২০০৮, ২০১৬ সাল।

এছাড়াও ফেডারেশন কাপে ২বার শিরোপা ও ৩বার রানার্স আপ হয়েছে। ডুরান্ড কাপে ২বার শিরোপা জয়ী ও ৩বার রানার্স আপ হয়েছিল।

সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ খেতাব ছিল আইএফএ শীল্ডে এই পর্যন্ত ৬বার শিরোপা অর্জন করেছে-১৯৩৬, ১৯৪১, ১৯৪২, ১৯৫৭, ১৯৭১, ২০১৪ সাল এবং ৪বার রানার্স আপ হয়-১৯৩৮, ১৯৬৩, ১৯৮২, ১৯৯০ সাল।

রোভার্স কাপে ৬বার শিরোপা লাভের অধিকারী কলকাতা মোহামেডান-১৯৪০, ১৯৫৬, ১৯৫৯, ১৯৮০, ১৯৮৪, ১৯৮৭ সাল এবং ৮বার রানার্স আপ হয়-

১৯৪১, ১৯৫৫, ১৯৫৭, ১৯৫৮, ১৯৮১, ১৯৮২, ১৯৮৩, ১৯৯১ সাল।

প্রাচীন কুচবিহার কাপে ৫বার চ্যাম্পিয়ন খেতাব অর্জন করে-১৯০২, ১৯০৬, ১৯০৯, ১৯৪৭, ১৯৫২ সাল।

বরদৌলুই ট্রফি প্রতিযোগিতায় ৬ বার চ্যাম্পিয়ন খেতাব পায়-১৯৬৯, ১৯৭০, ১৯৮৫, ১৯৮৬, ১৯৯১, ২০১৮ সাল এবং ৫বার রানার্স আপ হয়-৯৬৫, ১৯৬৬, ১৯৭১, ১৯৭৭, ১৯৮৩ সাল।

ডিসিএম ট্রফি প্রতিযোগিতায় ৪বার চ্যাম্পিয়ন খেতাব পেয়েছিল-১৯৫৮, ১৯৬১, ১৯৬৪, ১৯৮০ সাল।

ইন্ডিপেনডেন্ট ডে কাপ প্রতিযোগিতায় ৫বার শিরোপা জিতেছিল-১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৭২, ১৯৮৮, ২০০৭ সাল এবং মাত্র একবার রানার্স আপ হয়-২০১৮ সাল।

এছাড়া কলকাতা মোহামেডান ঢাকায় ১৯৬৯ সালে অনুষ্ঠিত আগা খান গোল্ডকাপ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়নের খেতাব অর্জন করেছিল।

এভাবে আরো অনেক অনেক বড় বড় খেতাবধারীর রেকর্ড আছে-যা লিখে শেষ করা যাবে না।

।। অন্যদৃষ্টি ।।

এলিস হক

১৯শে জুলাই ২০১৯

Facebook Comments
Print Friendly, PDF & Email
সংবাদটি শেয়ার করুন


আরো সংবাদ
Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com