শারীরিক শিক্ষা কেবল দৈহিক নয়, শারীরিক শিক্ষা সাধারণ শিক্ষার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। বর্তমান সময়ে শারীরিক শিক্ষা ছাড়া সাধারণ অসম্পূর্ণ, অপূর্ণাঙ্গ। আজকাল শারীরিক শিক্ষা বলতে শারীরিক উন্নয়ন, মানসিক বিকাশ ও সামাজিক গুণাবলি অর্জনকে বুঝায়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ যখন শারীরিক শিক্ষায় নিত্য গবেষণায় ব্যস্ত, নতুন নতুন কর্মপরিকল্পনা নিয়ে দেশের শারীরিক শিক্ষা ও খেলাধুলাকে এগিয়ে নিচ্ছে, দেশের উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে, আমরা তখন ঠিক তার উল্টো পথে। আমাদের শিক্ষা কারিকুলামে নামেমাত্র অন্তর্ভুক্ত করছি। শারীরিক শিক্ষা এবং খেলাধুলার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী যে গুণাবলি অর্জন করতে পারে, খেলাধুলার নিয়মকানুন মেনে ভালো করে খেলতে পারা। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য হাসিল করা। স্নায়ু ও মাংসপেশির সমন্বয় সাধনে কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করা। দেহ ও মনের সুষম উন্নতি করা। সুস্বাস্থ্যের মাধ্যমে শারীরিক সক্ষমতা অর্জন করা। সহিষ্ণুতা ও আত্মবিশ্বাস অর্জন করা। উপস্থিত চিন্তাধারার বিকাশ সাধন। নৈতিকতা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন। সেবা ও আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ হওয়া। বিভিন্ন দলের মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ ও প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব গড়ে? ওঠা। আনুগত্যবোধ ও নৈতিকতা বৃদ্ধি পাওয়া। খেলাধুলার মাধ্যমে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হওয়া। খেলোয়াড়ি ও বন্ধুত্বসুলভ মনোভাব গড়ে ওঠা। প্রতিদ্বন্দ্ব^ীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মনোভাব গড়ে? ওঠা। আত্মসংযমী হওয়া ও আবেগ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করা। নেতৃত্বদানের সক্ষমতা অর্জন ও সামাজিক গুণাবলি অর্জন করা। বিনোদনের সঙ্গে অবসর সময় কাটানোর উপায় জানা। সকলের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ ও সেবামূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা। সর্বোপরি তারা দেশপ্রেমে জাগ্রত হয়।
শারীরিক শিক্ষা হলো ১২ স্তরের শিক্ষার্থীদের শারীরিক সুস্থতা এবং কার্যকলাপ সম্পর্কে জানার জন্য একটি ক্লাস। এটি গুরুত্বপূর্ণ যাতে শিক্ষার্থীরা সুস্থতা সম্পর্কিত বিষয়গুলো, ফিটনেস এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত বিষয়গুলোসহ শিখতে পারে। একটি কার্যকর শারীরিক শিক্ষা কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত আকর্ষণীয় পাঠ, প্রশিক্ষিত শিক্ষক এবং নির্দেশের জন্য পর্যাপ্ত সময়। এটি শিক্ষার্থীদের ফিটনেস এবং সুস্থতার বিষয় সম্পর্কে শেখানো উচিত, যেমন ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য, সুস্থতা এবং আন্দোলনের দক্ষতা। পাঠগুলো আকর্ষক হওয়া উচিত যাতে শিক্ষার্থীরা উপাদানটি বুঝতে পারে। বিভিন্ন ধরনের ক্রিয়াকলাপ এবং গেমগুলোতে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে, শিক্ষার্থীরা তাদের আগ্রহ খুঁজে পেতে এবং ফিটনেস এবং সুস্থতার বিষয়ে তাদের জ্ঞানকে প্রসারিত করতে পারে। শারীরিক শিক্ষা কার্যক্রম সারাবিশ্বে পরিবর্তিত হয়। সঠিকভাবে শেখানো হলে ক্লাস ছাত্রদের স্বাস্থ্য, আচরণ এবং একাডেমিক কর্মক্ষমতা ওপর ইতিবাচক প্রভাব উৎপাদন করতে পারে। এর অংশ হিসেবে, স্বাস্থ্য শিক্ষা হলো রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ এবং চিকিৎসা সম্পর্কিত তথ্যের শিক্ষা।
অল্পের জন্য অনেক শারীরিক শিক্ষা ক্লাস তাদের শিক্ষার্থীদের কার্যকর ব্যায়ামে সহায়তা করার জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে। সবচেয়ে? সাশ্রয়ী মূল্যের এবং জনপ্রিয় সরঞ্জামের হলো একটি সাধারণ ভিডিও রেকর্ডার। এটির সাহায্যে শিক্ষার্থীরা নিজেদের রেকর্ড করে এবং প্লেব্যাক করার সময় তারা নিক্ষেপ বা দোলনার মতো কার্যকলাপে যে ভুলগুলো করছে তা দেখতে পারে। অধ্যয়নগুলো দেখায় যে ছাত্ররা এটিকে আরও কার্যকর বলে মনে করে যে কেউ তারা কী ভুল করছে তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে এবং তারপর এটি সংশোধন করার চেষ্টা করে।
শারীরিক শিক্ষা শারীরিক কার্যকলাপ এবং শারীরিক সুস্থতার জন্য মোটর দক্ষতা, জ্ঞান এবং আচরণ বিকাশের জন্য ডিজাইন করা জ্ঞানীয় বিষয়বস্তু এবং নির্দেশনা প্রদান করে। শারীরিক শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কারণ স্কুল বয়সই একমাত্র সময়, যেখানে শিক্ষার্থীরা সর্বোত্তম শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। এছাড়া সমাজ নিশ্চিত যে শারীরিক কার্যকলাপের গুরুত্ব সম্পর্কে বার্তা সঠিকভাবে পৌঁছানো যেতে পারে। একবার এটি জানা হয়ে গেলে, এটির প্রতিক্রিয়াগুলো আপনার সারাজীবনের জন্য আপনার স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োগ করা হবে। শারীরিক শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি রোগ, খারাপ অনুভূতি, ডাক্তারের কাছে যেতে এবং ওষুধ বা হাসপাতালে প্রতিরোধ করে। শারীরিক কার্যকলাপ স্বাস্থ্য রক্ষা করে এবং দীর্ঘ সময়ের জন্য সব রোগ দূরে রাখে। জিনিসগুলোর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখা দেয়। এটি এমনভাবে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে যে যদিও আমি একটি গোল করিনি বা একটি ঝুড়ি অর্জন করিনি। আমি খেলার তারকা মুহূর্ত ছিল না; আমি এটা আমার দলের সেরাদের মতো করিনি।
তবে আমি নিশ্চিত যে আমি আমার দল, আমার দলে অবদান রেখেছি। আমি আকর্ষণীয় কিছু করতে পেরেছি। শারীরিক শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি একবিংশ শতাব্দীর নাগরিককে দলগতভাবে প্রশিক্ষণ দিতে সাহায্য করে। এটি ক্রস-কাটিং থিমগুলোর বিকাশের অনুমতি দেয়। এগুলো যৌথভাবে পাঠ্যক্রমের অনেক ক্ষেত্রকে সম্বোধন করছে। দক্ষতার ওপর কাজ করা এবং উন্নতি করা এখন খুবই সাধারণ ব্যাপার। এটি মূল্যবোধে শিক্ষা দেয়। এটা শেখায় যে অন্যদের গ্রহণ করা অপরিহার্য। এটি একটি দলের মধ্যে প্রত্যেকের প্রচেষ্টা চিনতে সাহায্য করে। যখন উপভোগ করা এবং ভালো সময় কাটানোর কথা আসে তখন লোকেরা মূল্য দেয় এবং প্রত্যেকের গুরুত্ব স্বীকার করে। অন্যান্য চ্যালেঞ্জিং বিষয়ের তুলনায়, এটি অনেক সহজ এবং খেলাধুলার মতো মজাদার কার্যকলাপ অন্তর্ভুক্ত করে। যেসব ছাত্রছাত্রী খেলাধুলায় জড়িত, তারা এই বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে নেয় এবং পেশাগতভাবে দক্ষ হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। শারীরিক শিক্ষা এমন দক্ষতা তৈরি করে, যা মানুষের জীবনে বিকশিত হয়। এটি পরিবেশের অবস্থার ওপর নির্ভর করে কী করতে হবে, কীভাবে এটি করতে হবে, কখন এবং কার সঙ্গে করতে হবে তা জানার বুদ্ধি বিকাশ করে। শারীরিক শিক্ষা হলো শারীরিক শক্তি এবং তার জ্ঞানের বিষয়। এই বিষয়ের সঙ্গে জড়িত শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন শারীরিক কৌশল অধ্যয়ন করতে পারে। এই কৌশলগুলো খেলাধুলার সময় ব্যবহার করা যেতে পারে এবং দৈনন্দিন জীবনের রুটিনে সহায়ক হতে পারে।
কয়েক বছর থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ‘শারীরিক শিক্ষা’ বিষয় পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হলেও উচ্চ মাধ্যমিক তথা কলেজ পর্যায়ে বিষয়টি আজও অন্তর্ভুক্ত হয়নি। বিদ্যমান জনবল কাঠামো অনুসারে প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি কলেজে একটি করে শরীরচর্চা শিক্ষকের পদ রয়েছে। প্রায় সব কলেজে ‘শরীরচর্চা শিক্ষক’ থাকলেও তাদের পড়ানোর জন্য শারীরিক শিক্ষা বা এ জাতীয় কোনো বিষয় কিংবা পাঠ্যবই নেই। পরিসংখ্যানে জানা যায়, বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলে প্রায় চার হাজার কলেজে একজন করে শরীরচর্চা শিক্ষক কর্মরত আছেন। তাদের পড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় কিংবা বই নেই। প্রায় কলেজে একজন করে শরীরচর্চা শিক্ষক কর্মরত থাকলেও শারীরিক শিক্ষা নামের কোনো পাঠ্যবই নেই! কলেজ পর্যায়ে শরীরচর্চা শিক্ষক পদ থাকলে তাদের শিক্ষক পদমর্যাদা দেয়া হয় না। এটি একজন শিক্ষকের জন্য রীতিমতো অপমানজনক। কলেজ পর্যায়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয় বলে জানি। অর্থাৎ কলেজে যেসব বিষয় পঠিত হয়, সেসব বিষয়ের বিপরীতে শিক্ষক নেয়া হয়। কেবল খেলাধুলার জন্য কি শরীরচর্চা শিক্ষক অপরিহার্য? ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, জাপান, আমেরিকাসহ প্রায় সব দেশে কলেজ পর্যায়ে শারীরিক শিক্ষা বিষয়টি পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। শারীরিক বিকাশের সঙ্গে মানসিক বিকাশও অপরিহার্য একটি বিষয়। এই উভয় রকমের বিকাশ সাধনের জন্য শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার পাশাপাশি শারীরিক শিক্ষা গ্রহণও একান্ত প্রয়োজন। শিক্ষার্থীর সার্বিক বিকাশের জন্য কলেজ পর্যায়ে শারীরিক শিক্ষা চালু করা এখন সময়ের দাবি। শারীরিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে গিয়ে সি.এ বুচার বলেছেন, শারীরিক শিক্ষা, শিক্ষার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শারীরিক শিক্ষা হলো সুনির্দিষ্ট শারীরিক কাজকর্মের মাধ্যমে শারীরিক, মানসিক, আবেগিক এবং সামাজিক দিক দিয়ে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা। অন্য জে.বি ন্যাশ বলেছেন, শারীরিক শিক্ষা গোটা শিক্ষার এমন একটি দিক, যা মাংসপেশির সঠিক সঞ্চালন ও এর প্রতিক্রিয়ার ফল হিসেবে ব্যক্তির দেহের ও স্বভাবের পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধন করে। সামগ্রিক বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, শারীরিক শিক্ষার মূল কথা হলো, দেহ ও মনের সার্বিক উন্নতির লক্ষ্যে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সুষম উন্নয়ন, মানসিক বিকাশ সাধন, সামাজিক গুণাবলি অর্জন ও খেলাধুলার মাধ্যমে চিত্তবিনোদন। এক কথায়, আজকের শিক্ষার্থীদের আগামীদিনের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য শারীরিক শিক্ষা একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই কলেজ পর্যায়ে শারীরিক শিক্ষা বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়া একান্ত দরকার। আশা করি, দেশের সার্বিক উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের শিক্ষা কারিকুলামে কলেজ পর্যায়ে শারীরিক শিক্ষাকে চালু শিক্ষা ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে দেশের জনগণের এবং কলেজের শরীরচর্চা শিক্ষকদের মৌলিক দাবিটি এ বছরেই পূরণ করার উদ্যোগ নেয়া হবে। কলেজের ক্রীড়া উন্নয়নে শারীরিক শিক্ষা পাঠক্রম চালু ও শরীরচর্চা শিক্ষকদের পেশাগত বৈষম্য অবসানে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে দীর্ঘদিনের অবহেলা-বঞ্চনার অবসান ঘটানো হোক।
লেখক
শারীরিক শিক্ষা শিক্ষক
হাইমচর সরকারি মহাবিদ্যালয়, চাঁদপুর