।। অন্যদৃষ্টি স্পোর্টস ডেস্ক ।।
যারা নিয়মিত ফরাসী ফুটবল অনুসরণ করেন তাদের কাছে নাসির আল খেলাইফি অতি পরিচিত নাম। কাতারের এই ধনকুবের ফ্রান্সের ঘরোয়া ফুটবলের বর্তমান চ্যাম্পিয়ন প্যারিস সেইন্ট জার্মেইয়ের (পিএসজি) মালিক। তার মালিকানাধীন দলে নেইমার জুনিয়র, কিলিয়ান এমবাপ্পে, আনহেল দি মারিয়ার মতো বিশ্বসেরা ফুটবলাররা খেলে যাচ্ছেন।
তার তারকাখচিত ক্লাব সবসময় ইউরোপের শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনায় থাকলেও ব্যক্তি নাসির আল খেলাইফি সবসময় পাদপ্রদীপের বাইরে থাকতেই পছন্দ করেন। এজন্যই তার সম্পর্কে অনেক বিষয় অজানা রয়ে গেছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক ফরাসী ফুটবলের অলিখিত এই ‘সম্রাট’ সম্পর্কে।
কে এই নাসির আল খেলাইফি?
নামের আগে কোনো শেখ নেই এবং জন্মও কোনো ধনী পরিবারে হয়নি, তবু আরব তথ্য মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শীর্ষ ধনকুবেরদের মধ্যে একজন তিনি। ৪৫ বছর বয়সী নাসির আল খেলাইফি সম্পদের মূল্য ৪.৯ বিলিয়ন পাউন্ড। তার মালিকানাধীন কাতার স্পোর্ট ইনভেস্টমেন্ট ইউরোপীয় ফুটবলকে অর্থের ঝনঝনানিতে কাঁপিয়ে দিয়েছে। তবে তার শুরুটা কিন্তু অনেকটা শুন্য থেকে হয়েছিল।
‘জেলে’ থেকে টেনিস তারকা!
তার আসল নাম ওমান আল খেলাইফি। জন্ম অতি সাধারণ এক পরিবারে। তার মা সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য জানা যায়নি। তবে তার বাবা ছিলেন ‘মুক্তো জেলে’। একসময় পিতাকে আল খেলাইফি তার কাজে সহায়তাও করতেন। কাতার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করা আল খেলাইফি টেনিসে বেশ ভালো নাম কামিয়েছিলেন। তিনি এটিপি ট্যুরের দুই আসরে অংশ নিয়েছিলেন। তবে দু’বারই প্রথম রাউন্ড থেকে তাকে বিদায় নিতে হয়। যাই হোক, টেনিসের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পরই ব্যবসাবাণিজ্যের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে।
কাতারের আমিরের সঙ্গে বন্ধুত্ব
টেনিস ক্যারিয়ারের সুবাদে কাতারের আমির শেখ তামিমের সঙ্গে আল-খেলাইফির ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়। বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী দেশ কাতারের রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ সংস্থার প্রধান শেখ তামিম তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বন্ধু আল খেলাইফিকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেন।
২০০৮ সালে কাতার টেনিস ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আল-খেলাইফিকে নিয়োগ দেয়া হয়। এরপর তিনি এশিয়ান টেনিস ফেডারেশনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ৩ বছর পর তিনি কাতার ইনভেস্টমেন্ট অথরিটি’র অঙ্গ প্রতিষ্ঠান কাতার স্পোর্টস ইনভেস্টমেন্টের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন।
কাতারের তেল নির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য চালু হওয়া এই প্রতিষ্ঠানের মোট সম্পদের মূল্য ৩৩৮ বিলিয়ন পাউন্ড। এই প্রতিষ্ঠানই পরে পিএসজি’র সব শেয়ার কিনে নেয় আর আল-খেলাইফি ক্লাবের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব বুঝে নেন। ২০১৩ সালে শেখ তামিম তাকে কাতারের দফতরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন।
ওয়েনস্টিনের রাজত্বে হানা
দেশের ক্রীড়া জগতের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি আল খেলাইফি ক্রমেই ব্যবসা প্রসারে মনোযোগী হন, যার প্রথম ধাপ সম্প্রচার ব্যবসা। যখন ‘আল-জাজিরা স্পোর্ট’কে অধিগ্রহণ করে ‘বিইন স্পোর্ট’-এ পরিবর্তন করল ‘বিইন মিডিয়া গ্রুপ’, এর পেছনে মূল চাবিকাঠি ছিলেন আল খেলাইফি। এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী থাকা অবস্থায়ই ২০১৭ সালে তিনি হলিউডের জনপ্রিয় স্টুডিও ‘মিরাম্যাক্স’ কিনে নেন।
হলিউডের ‘মুভি মুঘল’ নামে পরিচিত হার্ভে ওয়েনস্টিন ও তার ভাই বব ওয়েনস্টিনের প্রতিষ্ঠিত ‘মিরাম্যাক্স’ পাল্প ফিকশন, গুড উইল হান্টিং এবং শেক্সপিয়ার ইন লাভ’র মতো অসংখ্য বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য পরিচিতি পেয়েছিল। পরে এর প্রতিষ্ঠাতা দুই ভাই হার্ভে ও বব ‘ডিজনি’র সঙ্গে যুক্ত হন।
আল-খেলাইফি যোগ দেয়ার পর, ‘মিরাম্যাক্স’ মাত্র ৬ মিলিয়ন পাউন্ড বাজেটে ‘হ্যালোইন’ চলচ্চিত্রের সিক্যুয়েল বানিয়ে সারা বিশ্বের বক্স অফিস থেকে ২৪০ মিলিয়ন পাউন্ড আয় করে। এরপর এক অনুষ্ঠানে হলিউডের অস্কারজয়ী তারকা লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিউ’র সঙ্গে আল খেলাইফিকে দেখা যায়।
ফ্রান্সের পর এবার ইংলিশ ফুটবলে বিনিয়োগে আগ্রহ
পিএসজিতে আল খেলাইফি বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করেছেন। বার্সিলোনা হতে ট্রান্সফার ফি’র বিশ্বরেকর্ড ২২২ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে নেইমারকে কিনে ফুটবল বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এরপর মোনাকো হতে ফরাসী তারকা কিলিয়ান এমবাপ্পেকে কিনে ট্রান্সফার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেকর্ডও পিএসজি নিজেদের করে নিয়েছে। এছাড়া বহু নামীদামী তারকা ক্লাবটিতে খেলছেন। সবমিলিয়ে রেলিগেশন অঞ্চল থেকে পিএসজিকে লীগ ওয়ানের সেরা দল বানিয়েছেন আল খেলাইফি। আর এই সবই আল খেলাইফির কারণে সম্ভব হয়েছে।
এবার আল খেলাইফির নজর বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফুটবল লিগ ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের দিকে। তবে বড় কোনো ক্লাব নয়, লীগের নিচু সারির কোনো ক্লাবকে কিনে নিজেদের বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে তাকে শীর্ষ পর্যায়ে তোলার আগ্রহ তার। শুরুতে নটিংহ্যাম ফরেস্ট এবং ব্ল্যাকবার্ন রোভার্সের সঙ্গে আলোচনা করলেও সর্বশেষ লিডস ইউনাইটেডের দিকে তিনি হাত বাড়াতে চলেছেন।
‘রহস্যমানব’ আল খেলাইফি
ধনকুবের এবং ক্রীড়াক্ষেত্রের অনেক বড় ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে আড়ালে রাখতেই বেশি পছন্দ আল খেলাইফির। তিনি এখনো বিয়ে করেছেন কিনা তাও জানা যায়নি। তবে তিনি এখনো সিঙ্গেল বলেই অনেকের ধারণা। প্যারিস আর দোহায় তার দুই ম্যানশনে তিনি আলাদাভাবে সময় কাটান। তবে এছাড়াও সারা বিশ্বে তার বহু সম্পদ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বলে গুঞ্জন শোনা যায়।
অন্যদৃষ্টি ।। এলিস হক