বৈরুতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের নেপথ্যে

অন্যদৃষ্টি অনলাইন
বৃহস্পতিবার, ৬ আগস্ট, ২০২০, ৮:২০ পূর্বাহ্ন

নিহত শতাধিক, ধ্বংসস্তূপে পরিণত নগরীর বিশাল অংশ

ভূমধ্যসাগর-পাড়ের দেশ লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ভয়াবহ দুই বিস্ফোরণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। স্থানীয় সময় গত মঙ্গলবার বিকাল ৬টার দিকে এ বিস্ফোরণ ঘটে। এতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। ৩ লাখ মানুষের বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে। বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত হয়েছে বৈরুত নগরের প্রায় অর্ধেকাংশ। নিহতের মধ্যে চার বাংলাদেশিও রয়েছেন। আহত হয়েছেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ২১ সদস্যসহ ৪ সহস্রাধিক মানুষ। সূত্র : বিবিসি, রয়টার্স, আলজাজিরা, সিএনএন।

প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, গুদামে দীর্ঘদিন ধরে মজুদ রাখা রাসায়নিক পদার্থ ‘অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট’ থেকে ঘটা বিস্ফোরণটির শক্তি ছিল পারমাণবিক বোমার মতো। বিস্ফোরণের শব্দে গোটা লেবানন কেঁপে ওঠে। বলা হচ্ছে, এ সময় ভূকম্পনের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৩.৫-এর বেশি। বিস্ফোরণে বৈরুত ছাড়াও আশপাশের অনেক শহর কেঁপে ওঠে। কম্পন অনুভূত হয় ২৪০ কিলোমিটার দূরের দ্বীপরাষ্ট্র সাইপ্রাসেও। সেখানকার বাসিন্দারা এ ঘটনাকে ভূমিকম্প বলে মনে করেছিলেন। কর্মকর্তারা জানান, বন্দরের এক বিস্ফোরকদ্রব্যের গুদামে ওই বিস্ফোরণের সূত্রপাত হয় আগুনের মাধ্যমে; বিস্ফোরণের পর ধোঁয়ার মেঘ কয়েক কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।
ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা গেছে, বিস্ফোরণের সময় বৈরুতের বন্দর এলাকা থেকে বড় গম্বুজ আকারে ধোঁয়া উড়ছে। এর কিছুক্ষণের মধ্যে বিকট বিস্ফোরণে গাড়ি ও স্থাপনা উড়ে যেতে দেখা যায়। বিস্ফোরণের পরপরই বৈরুত এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এদিক সেদিকে পড়ে থাকে ভাঙা কাচ। ভবনগুলো আগুনে পুড়ে যায়। বিস্ফোরণের মূল এলাকা থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে থাকা ভবনগুলোও বিধ্বস্ত হয়। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লেবাননে চরম গৃহযুদ্ধ চলার সময়ও এতটা ধ্বংসযজ্ঞ দেখা যায়নি। খবরে আরও বলা হয়, চিকিৎসা দিতে আশপাশের হাসপাতালগুলোয় নেওয়া হয় কয়েক হাজার আহতকে। বিস্ফোরণে হাসপাতালগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত। বিস্ফোরণস্থলের ২ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে অবস্থিত সেন্ট জর্জ হাসপাতাল। সেখানকার এক চিকিৎসক গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘আহতদের হাসপাতালে নিয়ে আসছে মানুষ, তবে আমরা তাদের ভর্তি করাতে পারছি না। তাদের রাস্তার ওপরে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। হাসপাতাল ভবন ভেঙে গেছে। ধ্বংস হয়ে গেছে জরুরি বিভাগ।’

লেবাননের রেডক্রসের প্রধান জর্জেস কেট্টানেহ সম্প্রচারমাধ্যম মায়াদিনকে বলেন, ‘আমরা যা দেখছি তা বড় ধরনের এক বিপর্যয়। চারদিকে হতাহতদের দেখা যাচ্ছে।’ দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিস্ফোরণের পরপরই বন্দর এলাকায় নিখোঁজদের সন্ধানে স্বজনদের ভিড় জমাতে দেখা গেছে। ভাইয়ের খোঁজে আসা এক তরুণী নিরাপত্তারক্ষীদের কাছে বারবার খোঁজ জানতে চাইছিলেন। ভাইকে চেনাতে তার শারীরিক গঠনের বর্ণনা দিচ্ছিলেন। বলছিলেন, ‘তার নাম জাদ। তার চোখগুলো সবুজ।’ তবে নিরাপত্তারক্ষীরা তাকে ভবনের ভিতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছিলেন না। আর ওই তরুণী বারবার তাদের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছিলেন ভিতরে যেতে দেওয়ার জন্য। পাশেই আরেক নারীকে দেখা যাচ্ছিল স্বজনের খোঁজে এসে তার অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার অবস্থা। তিনিও এসেছিলেন ভাইয়ের খোঁজে। তার ভাইও বন্দরেই কাজ করতেন। ওই এলাকায় নিয়োজিত এক সেনা সদস্য বলেন, ‘ভিতরে খুব খারাপ অবস্থা। মাটিতে মানুষের মৃতদেহ পড়ে আছে। এখনো মৃতদেহ উদ্ধার করে সেগুলোকে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানোর কাজ চলছে।’ বন্দর এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলোর ধ্বংসস্তূপ সরানো শুরু হলে মৃতের সংখ্যা অনেক বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হামাদ হাসান বলেন, ‘অনেক মানুষ নিখোঁজ রয়েছে। জরুরি বিভাগের কর্মীদের কাছে এসে লোকজন তাদের প্রিয়জনের সন্ধান চাইছে। রাতে অনুসন্ধান অভিযান চালানোটা কঠিন। কারণ সেখানে বিদ্যুৎ নেই।’ লেবাননের প্রেসিডেন্ট মাইকেল আউন তিন দিনের শোক ঘোষণা করেছেন। তিনি জানান, জরুরি তহবিল হিসেবে তার সরকার ১০০ বিলিয়ন লিরা (৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার) সহায়তা দেবে।

চার বাংলাদেশি নিহত : বিস্ফোরণের ঘটনায় অন্তত চার বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। লেবাননে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত চার বাংলাদেশির মৃত্যুর খবর জেনেছি। তারা এখানে বৈধভাবে কাজ করছিলেন। এ ছাড়া বিস্ফোরণে প্রায় ৮০ জন প্রবাসী বাংলাদেশির আহত হওয়ার তথ্য জানা গেছে। দুটি হাসপাতাল থেকে এ তথ্য জেনেছি। অন্য হাসপাতালগুলোয় যোগাযোগ করছি।’

বিস্ফোরণের নেপথ্যে : বৈরুত বন্দরের একটি অনিরাপদ গুদামে হাজার হাজার টন অত্যন্ত বিপজ্জনক দ্রব্য এ বিস্ফোরণের সম্ভাব্য উৎস। দেশটির প্রেসিডেন্টও এক টুইটে বলেছেন, কোনো ধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করে ২ হাজার ৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বন্দরে মজুদ করে রাখা হয়েছিল, এটা কিছুতেই ‘গ্রহণযোগ্য নয়’। বিস্ফোরণের কারণ বের করতে তদন্ত শুরু হয়েছে। দায়ীদের ‘সর্বোচ্চ সাজার’ মুখোমুখি হতে হবে বলে হুঁশিয়ার করেছে লেবাননের সুপ্রিম ডিফেন্স কাউন্সিল। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, ২০১৩ সালে একটি জাহাজ থেকে ওই অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট জব্দের পর সেগুলো বন্দরের একটি ওয়ারহাউসে রাখা হয়। এর পর থেকে বিপজ্জনক ওই রাসায়নিক সেখানেই পড়ে ছিল।

এ অবস্থায় বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, সাত বছর আগে জব্দ করা হলেও সেগুলো কেন ধ্বংস করা হয়নি, পর্যাপ্ত সুরক্ষাব্যবস্থা ছাড়াই ৪০ লাখ মানুষের বৈরুতের কেন্দ্রে কেন সেগুলো এত দিন থাকল? লেবাননের প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব বলেছেন, গত সাত বছর ধরে ওই গুদামে ২ হাজার ৭৫০ ম্যাট্রিক টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট মজুদ করে রাখা হয়েছিল। ২০১৪ সালে একটি মালবাহী জাহাজে করে ওই রাসায়নিক এসেছিল। কাগজপত্রে ঝামেলা থাকায় বন্দর কর্তৃপক্ষ জাহাজের সরঞ্জাম বাজেয়াপ্ত করে। তার পরই ওই রাসায়নিক গুদামে মজুদ রাখা হয়। কথা ছিল, পরে নিলামের মাধ্যমে ওই রাসায়নিক বাজারে ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু গত সাত বছরে সে কাজ করা যায়নি। শুধু তাই নয়, এ পরিমাণ রাসায়নিক যেখানে মজুদ ছিল, সেখানে যথেষ্ট নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না। গার্ডিয়ান জানায়, অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট জমিতে সারের কাজে লাগে। খনিতে কাজে লাগে। আবার বোমা তৈরিতেও ব্যবহার করা হয়। সহজেই এর থেকে বিস্ফোরণ হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশটির গণমাধ্যমে এ বিস্ফোরণের জন্য বন্দরের কাছের একটি আতশবাজির কারখানায় বড় ধরনের অগ্নিকান্ডকে দায়ী করা হচ্ছে। আতশবাজির কারখানার আগুন আশপাশের ভবনে ছড়িয়ে পড়ায় অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট মজুদের গুদামে মুহূর্তের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটে।

ভিন্নমত ট্রাম্প প্রশাসনের : যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এটিএফ বিস্ফোরক তদন্তকারী সাবেক কর্মকর্তা অ্যান্থনি মে সিএনএনকে বলেন, বিস্ফোরণের ভিডিওতে যে গাঢ় লাল ও উজ্জ্বল রঙের ধোঁয়ার কুন্ডলী দেখা গেছে; তা অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের ধোঁয়ার কুন্ডলী হলুদ বর্ণ ধারণ করবে। মে বলেন, ‘আমি বলছি না যে, এ বিস্ফোরণের সঙ্গে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এটা থাকতে পারে। তবে সেখানে অন্য উপাদানও ছিল।’ বিস্ফোরণের মাত্রা ও শহরজুড়ে প্রবল কম্পনের ব্যাপারে মে বলেন, ‘এটা কিছুটা ১ কিলোটন ওজনের পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের মতো ছিল। তবে এ বিস্ফোরণে পারমাণবিক কোনো পদার্থ ছিল না। কিন্তু সেখানে কম্পন তৈরি হয়েছে, বিস্ফোরণ ঘটেছে। এগুলো একটি ছোট আকারের পারমাণবিক ডিভাইসের সমতুল্য।’ বিস্ফোরণের এ ঘটনায় দ্বন্দ্ব তৈরি করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও।

লেবাননের জনগণের প্রতি শোক ও সমবেদনা জানিয়ে সহায়তার ঘোষণা দেওয়ার পাশাপাশি বিস্ফোরণের এ ঘটনাকে ‘ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা’ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। যদিও মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতরের তিনজন কর্মকর্তা ট্রাম্পের এ মন্তব্যের উল্টো মত প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, এ বিস্ফোরণে সন্ত্রাসী হামলার কোনো আলামত তারা পাননি। অন্যদিকে ট্রাম্প বলেন, ‘আমি আমাদের কয়েকজন জেনারেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি এবং তারা মনে করছেন, এটি কোনো উৎপাদনসংক্রান্ত বিস্ফোরণ ধরনের ঘটনা নয়। তারা মনে করেন এটি হামলার ঘটনা ছিল। এটি ছিল এক ধরনের বোমা বিস্ফোরণ। তারা আমার চেয়ে আরও ভালো জানেন।’

Facebook Comments
Print Friendly, PDF & Email


আরো সংবাদ
Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com