জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে আমাদের কী লাভ ? ______________________________
৩ নভেম্বর ২০২০ ইং মঙ্গলবার পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের ধারক-বাহক মার্কিন মূলুকে প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশন সম্পন্ন হল। ডেমেক্র্যাট চ্যালেন্জার জো বাইডেন ২৬৪ ইলেক্টোরাল ভোট পেয়ে রিপাবলিকান প্রার্থী ইনকামভেন্ট প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্পের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছেন। তার প্রাপ্ত ইলেক্টোরাল ভোট ২১৪। হোয়াইট হাউসে বসার জন্য উভয়ের প্রয়োজন ম্যাজিক ফিগার ২৭০ ভোট। ৫টি অঙ্গরাজ্য ভোট গণনা এখনো চলছে। হোয়াইট হাউসে বসার ম্যাজিকাল চেয়ারটি এখনো প্যান্ডুলামের মত ঘুরছে।
সারা পৃথিবী উৎকণ্ঠায় কে যাবেন হোয়াইট হাউসে। জো বাইডেন না কি ইনকামভেট প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প? কিন্তু যেই ভদ্রলোক প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হোক না কেন তাদের সাম্রাজ্যবাদী চিন্তা-চেতনা ও দর্শন কিছুতেই পরিবর্তন হবেনা।
৯/১১ -এ টুইন টাওয়ারে রহস্যজনক বিমান হামলার পর তদান্তীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে So called যুদ্ধ ঘোষণা দেন। অক্টোপাসের মতো তার পাশে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার। বেশিরভাগ খৃষ্টানপ্রধান দেশ নিয়ে গঠিত হলো বহুজাতিক বাহিনী। দুটি মুসলিমপ্রধান দেশ আফগানিস্তান ও ইরাক দখলে ক্রুসেডীয় বাহিনীর সমরসজ্জা!
ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার মিলিত খ্রীস্টান শক্তি অত্যাধুনিক অস্ত্রসজ্জিত হল।২০০১ সালে পরমাণু শক্তিধর পাকিস্তানের মাটি ও ঘাটি ব্যবহার করে কাপুরুষের মতো হামলা করলো দরিদ্র ও দূর্বল মুসলিম দেশ আফগানিস্তানে। কাবুল বিধ্বস্ত , ক্ষতবিক্ষত হল। বিনিময়ে সামরিক শাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফের ক্ষমতা পাকাপোক্ত ও দীর্ঘ করার বন্দোবস্ত করল। কাবুলকে ধ্বংস লীলা বানিয়ে মরণাস্ত্রের জুজু তুলে ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণ করল।
তখন জর্জ বুশের এহেন যুদ্ধংদেহী মনোভাব দেখে বিশ্বের শান্তিপ্রিয় সাধরণ মানুষ ছিলো আতংকিত ও উদ্বিগ্ন । ইরাক, আফগানে অনবরত বোমাবর্ষন আর দখলদারিত্বে নিহত হল প্রায় ১০ লক্ষাধিক মানুষ। তখন আবু গারিব, গুয়ান্তানামোর কারাগারে আটক মুসলমানদের বিরুদ্ধে অসভ্য বীভৎসতা দেখে বিশ্বের বিবেকবান মানুষ শিহরিত হয়েছিলো ! জর্জ বুশ, টনি ব্লেয়ার, কলিন পাওয়েল, কন্ডোলিৎসা রাইস এই নামগুলো সারাবিশ্বের মানুষের চোখে ঘৃনিত শব্দে পরিণত হয়ে গেলো। হিটলারের পর এতোটা নিন্দিত বিশ্বনেতা পৃথিবী হয়ত আর দেখেনি!
এই প্রেক্ষাপটে বিশ্বে এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির আবির্ভাব ঘঠল!তার বাবা আফ্রিকান অভিবাসী মুসলিম, মা আমেরিকান হোয়াইট খৃষ্টান।মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়ায় তার শৈশব কেটেছে। নির্বাচনী সমাবেশে তিনি হাজির হতেন ব্যক্তিত্ববান স্ত্রী মিশেল আর দুই কন্যা মালিয়া, সাসাকে সাথে নিয়ে। চমৎকার বাচনভঙ্গি, অসাধারন বাগ্মিতা আর মিস্টি হাসির যুবক ভদ্রলোক সহজেই মানুষের মন জয় করে নিলো। ঘোষণা দিলেন- যুদ্ধ বন্ধ হবে। নির্বাচিত হলে ইরাক, আফগান থেকে মার্কিন সেনা দেশে ফিরিয়ে আনবেন। গুয়ান্তানামো কারাগার বন্ধ করবেন।
এই বাস্তবতায় যুদ্ধ বিগ্রহ আর বারুদের উষ্ণ গন্ধে অতিষ্ঠ মানুষ কালো আকাশে আশার আলো দেখতে পেলো। সহজ সরল মুসলিম বিশ্ব ভাবলো মুসলিম বাবার সন্তান বারাক হোসাইন তার বাবার জাতির প্রতি অন্তত বুশের মতো নির্দয় ও নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারবেন না! সেই ইয়াং স্লিম কৃষ্ণাঙ্গ ভদ্রলোক বারাক হোসাইন ওবামা বিপুল জনপ্রিয়তায় ইলেক্টোরাল ভোটে মার্কিন প্রসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিলেন।
আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের মানুষ অধীর আগ্রহে আল্লাহ কে স্মরণ করে অপেক্ষা করছিলো রেজাল্টের জন্য। নরপিশাচ যুদ্ধবাজ মুসলিম বিদ্বেষী জর্জ বুশের পরাজয় দেখে তাদের মুখেও স্বস্তির হাসি ফুটে উঠলো। সেই শান্তিরদূত(!) ভদ্রবেশি বারাক দুই মেয়াদে ২০০৮ -২০১৬ ইং পর্যন্ত ৮ বছর হোয়াইট হাউসের অধিবাসী ছিলো। কিন্তু, ইরাক ও আফগানে মার্কিন সামরিক ঘাটি রয়ে গেলো। গোয়ান্তানামো কারাগারের বীভৎস ইতিহাস বন্ধ হলোনা।
তার পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট বুশ হামলা করেছিলো মাত্র দুটি দেশ ইরাক ও আফগানিস্তানে।অথচ, বারাক ওবামা হামলা করে ক্ষতবিক্ষত করে দিলেন লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়ামন, লেবানন, ফিলিস্তিন, সোমালিয়া, মিশর ও মিন্দানাও। বাদ যায়নি তাদের তথাকথিত সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের অন্যতম সহযোগী রাষ্ট্র পাকিস্তান! ড্রোন প্রযুক্তির মাধ্যমে বোমা হামলা করে পাকিস্তানের উপজাতি অধ্যুষিত এলাকা ও ইয়ামনের দরিদ্র মুসলমানদের জীবন দূর্বিষহ করে তুললো। রাজনৈতিক অস্থিরতা ছড়িয়ে দিয়ে অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করল তুরষ্কে। সেখানে ব্যর্থ হলেও সফল হলো মিশরও লিবিয়াতে।
রহস্যময় ও কুখ্যাত শক্তি আইএস এর উত্থান ছিলো টিম ওবামার আরেকটি সিক্রেট মিশন। মার্কিন অস্ত্র সহায়তায় গড়ে উঠা আইএসের মাধ্যমে নিরীহ মুসলিমদের হত্যা করা হলো পাইকারি হারে। বাংলাদেশেও এর আচড় এসে লাগলো হোলি আর্টিজানে নৃশংস হামলার মাধ্যমে!এরপর আইএস কে সাইনবোর্ড বানিয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিলো ইসলামোফোবিয়া আর মিডিয়া প্রোপাগাণ্ডা। অতঃপর, আইএস দমনের নামে সিরিয়া আর ইরাকে করা হলো নির্বিচার বিমান হামলা, পাঠানো হলো সেনা।
ফলশ্রুতিতে সিরিয়া নামের ঐতিহাসিক এই দেশটি রীতিমতো ধ্বংসস্তুপ! কয়েক কোটি সিরিয়ান নাগরিক পরিনত হয়েছে শরনার্থী। সম্ভ্রান্ত শিক্ষিত অভিজাত সিরিয়ানরাএখন ইউরোপের রাস্তাঘাটে ভিক্ষা করে বেড়ায়।
সেই ওবামার আট বছরে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল ফিলিস্তিনের গাজায় বড় আকারের ২০০৯,২০১১ও ২০১৪ সালে তিন বার সামরিক হামলা করেছে। প্রতিবারই তাদের বিমানভর্তি অস্ত্র ,অর্থ ও কূটনৈতিক সাহায্য দিয়ে সমর্থন করেছে আমেরিকা।
এমনকি ফিলিপিনের মিন্দানাও দ্বীপে মুসলিমদের স্বাধীনতা আন্দোলন দমানোর জন্য আমেরিকা সৈন্য প্রেরন করে।যেটি আমরা অনেকেই জানিনা।এভাবেই বিশ্বব্যাপী ব্যাপক হট্টগোল তৈরি করেন নোবেল পিস(!) লরিয়েট বারাক হোসেন ওবামা।ততোদিনে অনেকের স্বপ্নভঙ্গ হয়ে গেছে।তারা মনে মনে বললো- ‘ব্যাটা সাধুবেশে চোর!অনেকে আফসোস করে বললো- হায়, এর চেয়ে তো জর্জ বুশই ভালো ছিলো!
সুতরাং আমেরিকার হোয়াইট হাউসের গদিতে কে আসলো-গেলো তাতে আমাদের খুব বেশি উপকার নেই। মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ।এরা একটা যদি হয় নরক আরেকটা দোজখ। একজন ডিরেক্ট জবাই করবে আরেকজন হয়তো জবাইয়ের আগে একটু পানি পান করতে দিবে। এতটুকুই শুধু পার্থক্য।
লেখক :আবদুল মান্নান, শিক্ষাবিদ,গবেষক ও কবি