মানুষ মাত্রই মরণশীল অর্থাৎ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করলে তাকে অবশ্যই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। আর মৃত্যুর মাধ্যমেই পৃথিবীর সাথে মানুষের চির বিচ্ছেদ ঘটে। কিন্তু কিছু কিছু ব্যক্তি মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকেন। মৃত্যুর মাধ্যমেই পৃথিবীর সাথে মানুষের চির বিচ্ছেদ ঘটে।
কিন্তু কিছু কিছু ব্যক্তি মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকেন মানুষের মধ্যে, তাদের অমর কীর্তির জন্য। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ), ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, যীশু খ্রিষ্ট, গৌতম বুদ্ধ এঁরা সকলেই মানুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করে এক সময় মৃত্যুবরণ করেছেন কিন্তু তাঁরা আজও আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন তাঁদের মহান কীর্তির জন্য।
সক্রেটিস, এরিস্টটল নেই, রয়েছে তাঁদের দর্শন; শেক্সপিয়র, রবীন্দ্রনাথ নেই, রয়ে গেছে তাঁদের কাব্য। নিউটন, আইনস্টাইন চলে গেছেন না ফেরার দেশে রেখে গেছেন তাঁদের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও মতবাদ, যা আধুনিক বিজ্ঞানের চালিকাশক্তি রূপে আজও ব্যবহৃত হচ্ছে; পিকাসো, ভিঞ্চি আজ আর নেই আজও অম্লান আছে তাঁদের চিত্রকর্ম; বিটোফেন, মোজার্ট নেই, রয়েছে তাঁদের সুরসৃষ্টি। এভাবেই মানুষ বেঁচে থাকে তাদের মহান কর্মের মাধ্যমে। তেমনীভাবে স্মরনীয় বরনীয় হয়ে থাকবেন আল্লামা শফি তাঁর কৃত কর্মের মাধ্যমে।
মানব জাতি মানব সভ্যতার ধারাবাহিক ইতিহাসের ধারায় এমন কিছু দুঃখজনক, বেদনাদায়ক, হৃদয় গ্রাহী ঘটনা সংযোজিত হয়েছে যা অধ্যয়ন করলে মন শুধু ব্যথিত ও মর্মহত হয়। মানুষ মেনে নিতে পারেন না, ভুলে থাকতে পারেন না। ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায় এমন কিছু মহাস্থানের জীবন এই পূথিবীতে গেছেন, লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষ তার জন্য কাঁদেন তার চিরবিদায়ে। আজীবন স্মরণ রাখেন মানব জাতি ও মানব সভ্যতার চিরকল্যানকামী, ইসলামের পথপ্রদর্শক এ রকম এক মহাপুরুষ, আলেমে দিন বাংলাদেশের ইসলামি শীর্ষ ব্যক্তিত্বদের একজন তিনি শাহ আহমদ শফী; যিনি আল্লামা শাহ আহমদ শফী বা আল্লামা শফী নামেও পরিচিত।
তিনি ১৮ সেপ্টেম্বর ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) আল্লাহ যেন তাকে বেহেস্ত দান করুন আমিন। শফী, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থানার পাখিয়ারটিলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম এবং ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসায় শিক্ষালাভ করেন। আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলামে শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। ২০১০ সালে হেফাজতে ইসলাম নামে একটি ধর্মীয় সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন শফী। গত ১৬ সেপ্টেম্বর আহমদ শফীর পদত্যাগ এবং তার ছেলে আনাস মাদানীকে মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কারসহ ৫ দফা দাবি নিয়ে দারুল উলুম হাটহাজারীর ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে। ওই দিন রাতে আল্লামা শাহ আহমদ শফী বিক্ষোভের মুখে হাটহাজারীর মাদ্রাসার পরিচালকের পদ ছেড়েছেন। তার ছেলে আনাস মাদানীকেও মাদ্রাসার শিক্ষকের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। গত দু’দিন ধরে ছাত্র বিক্ষোভের মুখে মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটি বা শূরা কমিটির বৈঠকে শফী পরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘনের কারণ দেখিয়ে সরকার অনির্দিষ্টকালের জন্য হাটহাজারী মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণা করে। ছাত্ররা সরকারের এ ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যায়, আহমদ শফী পদত্যাগ করলে আন্দোলন সাময়িকভাবে স্থগিত ঘোষণা করা হয়। শফী ২০০৯ সালে আজিজুল হক ও অন্যান্য সিনিয়র ইসলামী ব্যক্তিদের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি একটি যৌথ বিবৃতি প্রদান করেন, যেখানে ইসলামের নামে সন্ত্রাস ও জঙ্গি কার্যক্রমের নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়। শফীর দেয়া বিভিন্ন বক্তব্য নিয়ে সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। চট্টগ্রামের তার দেয়া একটি বক্তৃতায় নারীদের প্রতি অবমাননাকর শব্দ ব্যবহার ও তাদের শিক্ষাগ্রহণের নিরুত্সাহিত করার নির্দেশ প্রদানের অভিযোগে বিভিন্ন নারী সংগঠন, বিশিষ্ট নাগরিক সমাজ এবং জনসাধারণ কর্তৃক সমালোচনার মুখে পড়েন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন ও ভাবধারার এবং রাজনৈতিক দলের মানুষের কাছেও বিতর্কিত।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আহমদ শফীর এই বক্তৃতার সমালোচনা করেন। হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে আহমদ শফীর বক্তব্যকে গণমাধ্যমে অপপ্রচার হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ২০১৪ সালের ১৮ এপ্রিল কক্সবাজারে একটি বক্তৃতায় তিনি নাস্তিকদের হত্যার কথা বলেন। যার প্রেক্ষিতে সমালোচনার সৃষ্টি হয়। মোবাইল ফোন তৈরি করে ইহুদিরা সমাজকে ধ্বংস করছে বলে মন্তব্য করার পর নির্বাসিতা লেখিকা ও বিতর্কিত কলামিস্ট তসলিমা নাসরিন তার বক্তব্যের সমালোচনা করেন। শুধু কী তাই তার মৃত্যু নিয়েও বিরুপ সমালোচনা করেছেন।
দীর্ঘ সময় ধরে কওমি শিক্ষার প্রসারে অবদান রাখেন। কিন্তু হঠাৎ করে আলোচনায় আসেন ১০ বছর আগে। যার অন্যতম কারণ হেফাজতের মত ধর্মবিক্তিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা, নারী নীতির বরোধীতা, ঢাকার শাপলা চত্তরে অবস্থান সর্বশেষ হাটহাজারি মাদ্রাসা পরিচালনার কর্তৃত্ব নিয়ে সৃষ্ট অপ্রীতিকর অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মধ্য মারা গেলেন দেশের এ শীর্ষ আলেম। দেশে কওমি শিক্ষায় শীর্ষ আলেম আল্লামা আহমদ শফির জন্ম চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার পাখিরাটিলা এলাকায়। পড়ালেখা করেন ভারতের দারুল ইলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায়। দেশে ফিরে শিক্ষকতায় যোগ দেন, হাটহাজারি মাদ্রাসায়।
তবে দশবছর আগেও তেমন আলোচনায় ছিলেননা আহমদ শফি। পাদপ্রদীপে আসেন ২০১০ সালে, নারী নীতির বিরুদ্ধে মাঠে নেমে। গঠন করেন কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম।
দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধীতা করে ২০১৩ সালের ৫ মে, ঢাকার শাপলা চত্বরে অবস্থান কর্মসূচি দেয় হেফাজত। সেই কর্মসূচি ঘিরে ব্যাপক সহিংসতার পর রাজনীতির মাঠে বড় পরিসরে আলোচনায় আসেন আহমদ শফি ও তার সংগঠন।
রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা নেই- বারবার এমন দাবি করলেও নানা ইস্যুতে বক্তব্য দিয়ে বরাবরই আলোচনায় ছিলেন এই ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। তার হাটহাজারি মাদ্রাসাটি হয়ে ওঠে হেফাজতের প্রধান কেন্দ্র। যেখানে যান বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
বলা হয়ে থাকে, নানা সমীকরণে সরকারের অনেকটাই ঘনিষ্ট হয়ে ওঠেছিলেন আহমদ শফি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এক অনুষ্ঠানে উপাধি দেন কওমি জননী হিসেবে। তবে সংগঠনটির মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীর সাথে মতবিরোধে হেফাজতের ভেতরে তৈরি হয় ফাটল। যার সর্বশেষ পরিণতি আহমদ শফি ও তার ছেলে আনাস মাদানিকে সরাতে ছাত্র আন্দোলন।
আহমদ শফি ১৯৮৬ সাল থেকে টানা মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন হাটহাজারি মাদ্রাসার। কিন্তু ছাত্র আন্দোলনের মুখে গত বৃহস্পতিবার সেই দায়িত্ব ছাড়েন। দুদিন অবরুদ্ধ অবস্থায় থেকে অসুস্থ হয়ে পড়লে নেয়া হয় হাসপাতালে। যেখানে জীবনাবসান ঘটে তার। জীবদ্দশায় ছিলেন বেফাকুল মাদরিসিলি আরাবিয়া বাংলাদেশের চেয়ারম্যান।
উল্লেখ্য, গত ১৮সেপ্টেম্বর শুক্রবার সন্ধ্যায় আল্লামা শাহ আহমদ শফী মারা যান। শফী দীর্ঘদিন যাবৎ বার্ধক্যজনিত দুর্বলতার পাশাপাশি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন।
কথায় বলা হয় মানুষ নিজ সত্তাকে হারিয়ে ফেলতে ভয় পায়। সে চায় এই সুন্দর ভুবনে নিজ সত্তাকে ধরে রাখতে। এজন্যই মানুষ অমরত্বের স্বপ্ন দেখে’ -আমার মতে অমরত্ব হচ্ছে নিজ সত্তাকে অবিনশ্বর রেখে আজীবন বেঁচে থাকা। প্রত্যেকেরই অন্তরে রয়েছে এই ধরণীর জন্য অগাধ ভালোবাসা। নিজ সত্তাকে মানুষের মাঝে জীবিত রেখে সে এই লীলাভূমিতে আরও কিছুটা দিন বেঁচে থাকতে চায়। মানুষের এই ইচ্ছাকেই মূলত অমরত্ব বলে অভিহিত করা যায়। প্রকৃত অমরত্ব আসে কীসে? -কোনো ব্যক্তির সুকর্ম মৃত্যুর পরও তাকে তার কর্ম দ্বারা উপকৃত মানুষের মাঝে বাঁচিয়ে রাখে। পৃথিবীতে বহু ইসলামী ব্যক্তিত্ব, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, লেখক, কবি, সমাজ ও ধর্ম সংস্কারক, বীর ও পণ্ডিত আছেন যাদের আদর্শ শত শত বছর ধরে মানুষ অবলম্বন করছে। সুতরাং কর্মের মধ্যে বেঁচে থাকাই প্রকৃত অমরত্ব। অমরত্ব অর্জন কি খুবই দুঃসাধ্য? -না। কর্মের মধ্য দিয়ে মানুষের অমরত্ব অর্জন অবশ্যই সম্ভব। পূর্বসূরিরা সর্বদাই চায় যে উত্তরসূরিরা পূর্বসূরিদের গুণ, নীতি, জীবনাচরণ, আদর্শ বহন করুক।
মৃত্যু মানুষের জীবন যাত্রাকে থামিয়ে দেয়। কিন্তু কর্মের ফল এবং গুণাগুণ বিদ্যমান থাকবে
পৃথিবী ধ্বংসের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত। মানুষের ক্ষণস্থায়ী জীবন থেমে যেতে পারে যেকোনো মুহূর্তে। কিন্তু নিজ কর্মের মাধ্যমে মানুষ বেঁচে থাকে অনন্তকাল। কর্মের দ্বারাই মানব মনে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নেয়া যায়। মানুষ যেকোনো ব্যক্তিকে তার কর্মফল বা কর্মগুণ দ্বারা বিখ্যাত বা কুখ্যাত হিসাবে মূল্যায়ন করে দীর্ঘকাল যাবত। মহৎ কর্মই মানুষকে অমরত্ব দান করে। মহৎ সৃষ্টিশীলতার জন্যই মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ভাল
কাজই মানুষকে এক যুগ থেকে অন্য যুগে পৌঁছে দেয়। মানুষকে শ্রদ্ধা, ভক্তি ভালোবাসায় সিক্ত করে। পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ এসেছে, অনেকে চলে গেছে, কিন্তু মহাকালের যাত্রায় স্থান করে
নিয়েছে খুব অল্প সংখ্যক মানুষ। তাঁদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে তাঁদের মহৎকর্ম। মানবজীবনের
সবচেয়ে বড় অর্জন হলো তার মহৎকর্ম। মৃত্যুর পরও মানুষ তার মহৎ কর্মগুণে অমরত্ব লাভ করে। মহামানবদের দৈহিক মৃত্যু ঘটলেও তাদের মহৎ কর্ম আজও শাশ্বত অম্লান। বিশ্বকবি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম, মাদার তেরেসা, বিজ্ঞানী আইনস্টাইন, নিউটন প্রমুখ তাঁদের কর্মের মাধ্যমে আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন। তেমনভাবে আজীবন স্মরনীয় হেয়ে থাকবেন আলেমেদিন শফি সাহেব। মৃত্যুর পরেও তাঁরা মানুষের হৃদয়ে শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় বেঁচে থাকবেন। তাঁর কর্মই তাকে বাঁচিয়ে রাখবেন। তিনি বাংলায় ১৩টি ও উর্দুতে ৯টি বইয়ের রচয়িতা তিনি। আলেমদের বড় একটি পক্ষের কাছে খুব শ্রদ্ধার পাত্র। তবে নারীবিরোধী নানা বক্তব্যের জন্য বিভিন্ন সময় হয়েছেন সমালোচিত। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ২০১৩ সালে গণজাগরণ আন্দোলন শুরুর পর হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে তিনি বেশি আলোচনায় আসেন। ২০১৭ সালে তার সঙ্গে বৈঠকের পর কওমির সনদের স্বীকৃতি এবং সুপ্রিম কোর্ট থেকে ভাস্কর্য অপসারণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক হিসেবে কওমি মাদ্রাসাগুলোর নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন আহমদ শফী, যাদের কাছে তিনি ‘বড় হুজুর’ নামে পরিচিত। তিনি কওমি মাদ্রাসা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশেরও (বেফাক) সভাপতি ছিলেন।
লেখক
সভাপতি, জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা